উন্নয়ন বঞ্চনায় বগুড়া
বিগত সরকারের দীর্ঘ সময়ে বড় দাবিগুলোর কোনোটাই পূরণ হয়নি বগুড়াবাসীর। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় এই জেলার উন্নয়ন নিয়ে চলেছে নানা বৈষম্য। এখন পটপরিবর্তনে বঞ্চিত বগুড়াবাসী আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছেন। তারা মনে করছেন, উত্তরের রাজধানী খ্যাত এই জেলায় দীর্ঘ সময় পর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হবে।
বগুড়ায় একটি পূর্ণাঙ্গ বিমান বন্দর রয়েছে। আরও রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম। এছাড়া দ্বিতীয় বিসিক শিল্প নগরীর জন্য নির্ধারিত স্থান ছাড়াও সিরাজগঞ্জ-বগুড়া রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের কার্যক্রম চূড়ান্ত রূপে মন্ত্রণালয়ে পড়ে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। একইভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ ও অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ প্রকল্পটিও রয়েছে শুধু অনুমোদনের অপেক্ষায়। কিন্তু শুরু থেকেই এই প্রকল্পগুলো নিয়ে বিগত সরকার ছিল উদাসীন। নানা প্রতিবন্ধকতার অজুহাতে দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে ফাইলবন্দি রয়েছে সেগুলো। উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর দুই বিভাগের মধ্যে বগুড়ায় দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে দারিদ্র্যের গড় হার ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ হলেও বগুড়ায় এই হার মাত্র ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। বগুড়ায় দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা কিছু শিল্প-কারখানা এখানকার উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। বগুড়ায় বিশেষত কৃষি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় যন্ত্র এবং যন্ত্রাংশ তৈরির অনেক কারখানা রয়েছে। সাবান কারখানার জন্য বগুড়ার খ্যাতি আছে। রবিশস্য উৎপাদনের জন্যও এখানকার মাটি খুবই উপযোগী। যার কারণে এই জেলায় উন্নয়ন ধারাবাহিতকা থাকার কথা থাকলেও বিগত সময় সেটি হয়নি বলে জানিয়েছেন এখানকার ব্যবসায়ী নেতারা।
বগুড়াবাসীর অন্যতম একটি দাবি হলো সিটি করপোরেশন ঘোষণা। বিগত জোট সরকারের শাসনামলে সিটি করপোরেশন করার লক্ষ্যে বগুড়া পৌরসভার আয়তন বাড়ানো হয়। এখন ২১টি ওয়ার্ড নিয়ে ৬৯.৫৬ বর্গকিলোমিটার এলাকার বিশাল একটি পৌরসভা রয়েছে। এতো বড় এলাকা সামাল দিতে পৌরসভার সীমিত বাজেটে হিমিশিম খেতে হয়। যার কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে শহরবাসী বঞ্চিত রয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। বিগত সরকার রংপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করেছে। কিন্তু বগুড়াকে তালিকায় আনা হয়নি। অথচ সিটি করপোরেশনে উন্নীতকরণের শর্ত অনেক আগেই পূরণ করেছে বগুড়া। শুধুমাত্র রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে বগুড়া সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন হয়নি বলে মনে করেন স্থানীয় নাগরিক সমাজ।
এদিকে বগুড়া বিমানবন্দর চালুর সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগেই। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) প্রতিনিধি দল সম্ভাব্যতা যাচাই করে। এটি চালুর পক্ষে তারা প্রতিবেদনও দিয়েছেন। কিন্তু বিমানবন্দর চালুর ‘সবুজ সংকেত’ বন্দি হয়ে আছে লাল ফাইলে। এটি চালু হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা এমনটিই বলেছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। এ দুই জেলার মধ্যে সরাসরি রেলপথ না থাকায় উত্তরাঞ্চলের ট্রেনগুলোকে যাত্রী ও কৃষিপণ্য নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়। বগুড়া থেকে তিন জেলার সীমানা পেরিয়ে প্রায় ৪০৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে সময় লাগে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা। আর সড়কপথে ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বাসে করে ঢাকা যেতে সময় লাগে ৬ ঘণ্টা। মহাসড়কে এখন যানজট থাকায় বাসে সময় কখনো কখনো ৭ থেকে ৮ ঘণ্টাও লেগে যায়। অথচ বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতুতে সরাসরি ট্রেনযোগে পৌঁছাতে সময় লাগবে এক থেকে সোয়া ঘণ্টা। বগুড়া থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রেন সার্ভিস চালু হলে বগুড়াসহ উত্তরের জেলার ট্রেনযাত্রীদের প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পথ কমে আসবে। সেইসঙ্গে খরচ কমে গিয়ে উত্তরের ট্রেন যাত্রীদের অর্থ সাশ্রয় হবে। তবে নানা জটিলতায় এই প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু করাই হয়নি।
অর্থনৈতিক অঞ্চলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। স্থান নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলায় ২৫১ একর জায়গা নির্ধারণ করে। সেখানেই অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ার কথা। উদ্দেশ্য শিল্পনগরীখ্যাত বগুড়ার হারানো গৌরব ফেরানো। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও এই কাজের অনুমতি মেলেনি।
এছাড়া ১৬ বছর ধরে শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করা হয়নি। এই সময়ে স্টেডিয়ামের সংস্কার বা উন্নয়ন কাজ হয়নি। অথচ এই স্টেডিয়ামটি উত্তরাঞ্চলের গর্ব। ক্রিকেটের নক্ষত্র তৈরির মাঠ বলা হতো এটাকে। মুশফিকুর রহিম, শরিফুল ইসলাম,অনূর্ধ্ব-১৯ দলের তামিম, তৌহিদ হৃদয়, খাদিজাতুল কোবরা, শারমিন সুলতানা, ঋতু মনিসহ আরও অনেক ক্রিকেটার তৈরির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রয়েছে মাঠটির।
শহরের ফুলদীঘিতে বাংলাদেশ টেলিভিশন বগুড়া আঞ্চলিক কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও পরবর্তীতে সেই প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি। প্রতিষ্ঠিত হয়নি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সিদ্ধান্ত হওয়ার পরও উত্তরাঞ্চলের প্রাচীন এই জনপদে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন শিক্ষাবিদরা।
বগুড়া বড় প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয় ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে। পাইপলাইনে গ্যাস সঞ্চালন, শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়াম পুনর্নির্মাণ, বনানী থেকে মাটিডালী পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ, সাতমাথা থেকে তিনমাথা পর্যন্ত রাস্তা প্রশস্তকরণ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ, বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ক্রিসেন্ট ব্রিজ, এসপি বিজ্রের মতো অনেক প্রকল্প ছিল এই তালিকায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বগুড়ার উন্নয়নে স্থবিরতা নেমে আসে। এমনকি জেলার উন্নয়ন বরাদ্দেও বগুড়া পিছিয়ে পড়তে থাকে। প্রচলিত এবং অত্যাবশ্যকীয় ছাড়া কোনো কাজ হয়নি এই জেলায়। আর তাই দীর্ঘদিন উন্নয়নবঞ্চিত এই জেলার সাধারণ মানুষ মনে করছেন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের এই সময়ে বগুড়া তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।
শিক্ষাবিদ ফজলুল করিম বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় একটি জেলার পরিচিতি পেতে পারে না। এখানে বিএনপির যেমন ভোট রয়েছে তেমনি আওয়ামী লীগের ভোট সংখ্যাও কম নয়। এ কারণে উন্নয়ন বঞ্চিত করা রাখা ঠিক সিদ্ধান্ত নয়।
সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) বগুড়ার সাধারণ সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, জেলার উন্নয়ন ছাড়াও শিক্ষা, যুবসমাজ এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন, কৃষি খাত, ক্ষুদ্র শিল্প, তরুণ এবং নারী উদ্যোক্তাদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বেকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। বগুড়া দীর্ঘদিন এসব থেকে বঞ্চিত রয়েছে।
এফএ/এমএস