ঘরের দুয়ারে সুপেয় পানি পৌঁছে দিয়েছে হাইসাওয়া
কক্সবাজারের রামুর চাকমারকুল ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের পূর্ব শাহ আহমদেরপাড়া একটি জনবহুল গ্রাম। চারপাশে চাষাবাদের জমি বেষ্টিত গ্রামটিতে সুপেয় পানির সংকট গত এক দশক ধরে। শুষ্ক মৌসুমে একাধিক সেচ প্রকল্প বসানোর ফলে পাড়ার অগভীর নলকূপে পানি যেন ‘সোনার হরিণ’ হয়ে দেখা দেয়। তাই সারাদিন সংসারের ঘানি টেনে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আধা কিলোমিটার দূরে সামসুন নাহারের ছুটতে হতো খাবার পানির জন্য।
শুধু সামসুন নাহার নয়, এ গ্রামের হাজারো পরিবার খাবার পানির তীব্র সংকটে রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে নলকূপে পানি পাওয়া যায় না। আর বর্ষায় পানি পাওয়া গেলেও ময়লার কারণে খাওয়া যায় না। এক কিলোমিটার দূরের এক বাড়ির গভীর নলকূপ থেকে লাইন ধরে পানি সংগ্রহ করতে হয় সবার।
সুপেয় পানির এ সংকট দূর করতে গ্রামটিতে ত্রাতা হয়ে এসেছে স্থানীয় সরকার বিভাগের অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘হাইসাওয়া’ নামে এক সংস্থা। ডেনমার্ক সরকারের আর্থিক সহায়তায় এলজিডির ‘হাইসাওয়া’ প্রকল্প এরইমধ্যে এলাকার অর্ধশত পরিবারের সুপেয় পানির সংকট দূর করেছে। সৌরবিদ্যুতকে কাজে লাগিয়ে গভীর নলকূপের মাধ্যমে তোলা পানি পরিকল্পিত লাইনে মোট ১০০টি ঘরে সরবরাহ করা হচ্ছে। একইসঙ্গে রামুর ৫টি ইউনিয়নে মোট ১১০টি গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে হাইসাওয়া। যেসব উৎস থেকে নিরাপদ পানি পাচ্ছে প্রায় এক হাজার ২০০ পরিবার। এতে দূর হচ্ছে সুপেয় পানির সংকট।
চাকমারকুল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সংরক্ষিত নারী সদস্য মরিয়ম বেগম জানান, ইউনিয়নের পূর্ব ও পশ্চিম শাহমদের পাড়ায় প্রায় দুই হাজার ভোটারসহ ৫ হাজার মানুষের বাস। এ পাড়া দুটির অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। ঘনবসতিপূর্ণ এ গ্রামগুলোতে পানি ও স্যানিটেশন বড় সমস্যা। দীর্ঘ বছর ধরে পাড়া দুটিতে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। গ্রীষ্মে বিপুল পরিমাণ সেচপাম্প বসানোর ফলে এ সময় টানা কয়েক মাস সংকট প্রখর হয়। অন্য সময় বাড়ির নলকূপে পানি মিললেও তা আয়রনে ভরা। স্থানীয়রা গরিব হওয়ায় বসাতে পারেন না গভীর নলকূপ।
এ অবস্থায় এলজিডির হাইসাওয়া প্রকল্প এলাকায় আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। সৌরবিদ্যুৎ চালিত ‘পাইপ ওয়াটার সাপ্লাই সিস্টেম’ প্রকল্পে এলাকার ১০০ পরিবারকে টার্গেট করে এরইমধ্যে অর্ধ-শতাধিক পরিবারকে সুপেয় পানি সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে।
সম্প্রতি এলাকায় গেলে প্রকল্পের উপকারভোগী হুমায়ুন আজাদ, ছৈয়দ আকবরসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ৭-৮শ ফুট নিচে গিয়েও খাবার উপযোগী পানি মেলে না। সুপেয় পানির যোগান দিতে এক থেকে দেড় লাখ টাকায় গভীর নলকূপ বসানোর সামর্থ্য এলাকার একক কারো ছিল না। আগে দূষিত পানি ব্যবহারে নানা ধরনের চর্মরোগ হতো। চিকিৎসা করানোর সামর্থ্যও ছিল না। কিন্তু সরকার পাইপলাইনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করে দিয়েছে, এতে দারুণ উপকার হয়েছে আমাদের। কমেছে রোগের ঝুঁকিও।
তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভারী যানবাহন চলাচলে নষ্ট হওয়া সড়কটি মেরামত না করায় এখন জন চলাচলে ভোগান্তি বেড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকার অনেকে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ডেনমার্ক সরকারের আর্থিক সহায়তা ও স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রচেষ্টায় প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে এই পানি সরবরাহ সেবা চালু হয়েছে। ‘কক্সবাজারে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জন্য অভিযোজনমূলক প্রকল্প’ নাম দিয়ে প্রকল্প ব্যয়ের ১০ শতাংশ অর্থাৎ দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন স্থানীয় উপকারভোগীরা।
তারা আরও জানান, পাঁচ বছর মেয়াদী এ প্রকল্পের আওতায় স্থাপন করা হয়েছে ৮১০ ফুট গভীর নলকূপ ও আধুনিক মোটর। অবকাঠামো গড়ে ২০ ফুট উঁচুতে বসানো হয়েছে ৫ হাজার লিটার ধারণক্ষমতার পানির ট্যাংক। পাইপলাইনের মাধ্যমে এরইমধ্যে ৫৫টি পরিবার সরাসরি পানি পাচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ১০০ পরিবারকে এতে সংযুক্ত করা হবে। বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে বসানো হয়েছে উচ্চ ক্ষমতার সোলার প্যানেল।
নলকূপ স্থাপনে জমি দান করা স্থানীয় বাসিন্দা ছৈয়দ আহমদ বলেন, খাবার পানির জন্য বউ-ঝিদের এক বা আধা কিলোমিটার দূরে এক বাড়িতে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হতো। দুর্ভোগ চিন্তা করে খুশি মনে জমি দিয়েছি। গত জুলাই মাসে বিদেশি এক মেহমান (ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত) আমাদের পানির লাইনটি উদ্বোধন করে যান। এ প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপকৃত হচ্ছে। আরও তিনটি নলকূপ স্থাপনে কাজ চলছে বলে জেনেছি।
বণিক পাড়ার ঝিনুক ও মুক্তাধর বলেন, বিল ও পুকুরের পানি দিয়ে দৈনন্দিন কাজ সারতাম। খেতাম আয়রনযুক্ত পাইপের পানি। এখন গভীর নলকূপের পানি লাইনের মাধ্যমে ঘরের দরজায় পেয়ে সমস্যা দূর হয়েছে।
হাইসাওয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল ওসমান বলেন, কক্সবাজার ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা। এখানে সুপেয় পানির সংকট তীব্র। উৎস কম থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে দূষিত পানি পান করে। গভীর নলকূপ স্থাপনে খরচ বেশি, তাই অনেকের পক্ষে তা স্থাপন সম্ভব হয় না। এজন্যই তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে হাইসাওয়া।
কক্সবাজার সদরসহ টেকনাফ, উখিয়া এবং রামুতে সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন সেবাসহ নানান প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, হাইসাওয়া জেলার চার উপজেলার ২১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় গত অর্থবছরে ৮০০টির বেশি পানির উৎস এবং ল্যাট্রিন নির্মাণ করেছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২৭টি জেলায় এক হাজার ১০০টিরও বেশি ইউনিয়ন পরিষদে ৮৪ হাজারেরও বেশি পানির উৎস স্থাপন এবং ১৭ লাখেরও বেশি স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন নির্মাণ ও সংস্কার করে দিয়েছে সংস্থাটি।
রামুর চাকমারকুল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম সিকদার জানান, নিরাপদ পানির কারণে প্রায় সময় পরিবারের সদস্যরা পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত থাকতো। ডেনমার্ক সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় এলজিডি ঘরে ঘরে সুপেয় পানির সংকট দূর করবে বলায় জমির ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এলাকার লোকজন পানি সংকট থেকে মুক্তি পেয়েছে দেখে ভালো লাগছে।
নিরাপদ পানি সরবরাহের পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকায় স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করে হাইসাওয়া। সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড মুন্সীপাড়ার বাসিন্দা ঝর্ণা ধর বলেন, ঘরের দুঃখ বহুকালের। তবে উন্নত ল্যাট্রিন পেয়ে অনেক খুশি। সন্তানেরা স্যানিটেশন সুবিধা পাচ্ছে। স্বাস্থ্য সচেতন হচ্ছে।
ঝর্ণার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে প্রিমা দাশ বলেন, আগে যে ল্যাট্রিন ছিল তাতে বৃষ্টি হলে পানি পড়তো। দুর্গন্ধে যাওয়া যেতো না। মেয়েদের অনেক সমস্যা থাকে। এখন আধুনিক ল্যাট্রিন পেয়ে দুর্ভোগ কমেছে।
হাইসাওয়ার কমিউনিটি অর্গানাইজার তহুরা আকতার বলেন, হাইজিন, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তাসহ সাতটি বিষয়ের ওপর ২৫ জন নারী নিয়ে উঠান বৈঠক হয়। মাসে ২৪টি সেশন করানোর মধ্য দিয়ে নারীরা সচেতন হচ্ছেন।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কক্সবাজারে নিরাপদ পানির সংকট তীব্র। এ সংকট দূর করতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। রামুতেও এলজিডির মাধ্যমে হাইসাওয়া সংস্থাটির কাজ আমাদের জন্য সহায়ক।
এফএ/এমএস