এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে আগুন

একযুগ পেরিয়ে গেলেও আলোর মুখ দেখেনি মামলা

আহমেদ জামিল
আহমেদ জামিল আহমেদ জামিল , জেলা প্রতিনিধি সিলেট
প্রকাশিত: ১২:৪৭ পিএম, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনার একযুগ পূর্ণ হয়েছে গত ৮ জুলাই। ২০১২ সালের সেইদিনে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে নির্মিত আসাম স্থাপত্যরীতির এই স্থাপনাটি। দীর্ঘ একযুগ পার হলেও এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার কোনো অগ্রগতি নেই।

মামলার অন্যতম আসামি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের মামলা বাতিলের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সাল থেকে স্থগিত রয়েছে সকল কার্যক্রম। শুধু তাই নয়, ‘রাজনৈতিক প্রভাবে’ ৫ বছর ধরে আটকে আছে উচ্চ আদালতের একটি আদেশ। সর্বশেষ গত ১২ আগস্ট আদেশটি সিলেটের আদালতে আসার কথা ছিল। কিন্তু এই তারিখেও আদেশটি পৌঁছায়নি। যার কারণে আগামী ১২ নভেম্বর মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য্য করেছেন আদালত।

এদিকে ৫ বছর ধরে মামলাটি কেবল স্থগিত করে রাখাই হয়নি, মামলাটির কোনো তথ্যও অনলাইনে মিলছে না। যার কারণে মামলাটি প্রায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে আছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থার পেছনে দায়ী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সিলেটের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অফিস। আদেশটি উচ্চ আদালত থেকে না আনার পেছনে তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এ অবস্থায় মামলটির বিচারকার্য প্রলম্বিত করার কারণে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্র ও মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, উচ্চ আদালত থেকে জামিনে থাকা অন্যতম আসামি দেবাংশু দাস মিঠু, আবু সরকার, জাহাঙ্গীর আলম, কামরুল ইসলাম, জ্যোতির্ময় দাস সৌরভ ও অ্যাডভোকেট আলমগীর মামলাটি কোয়াশম্যান্টের (কার্যধারা বাতিল) জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও জাফর আহমদের গঠিত বেঞ্চ মামলাটির কার্যক্রম ৬ মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেন।

একইসঙ্গে দুই বিচারপতি অন্তর্বর্তী এক আদেশে শাহপরাণ (রহ.) থানার মামলা নং ৯(১৩/০৭/২০১২), জিআর মামলা নং ১০০/২০১২ দণ্ডবিধির ১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩২৪/৩২৬/৪৩৬/৪২৭ ধারায় চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সিলেটের চলমান মামলাটি কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে রুল ইস্যু করেন। ৬ মাসের মধ্যে উচ্চ আদালতে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

রাষ্ট্রপক্ষের জবাবের পর উচ্চ আদালত থেকে কোনো আদেশ এখনো সিলেটের আদালতে আসেনি। এমনকি অনলাইনে উচ্চ আদালতের আদেশের কোনো তথ্য নেই।

উচ্চ আদালত থেকে আদেশটি সিলেটে না আসায় ২০১৯ সাল থেকে মামলাটি স্থগিত রয়েছে। সর্বশেষ ১২ আগস্ট সিলেটের আদালতে আদেশটি আসার কথা ছিল। এদিন আদালত মামলার শুনানির দিন ধার্য করেছিলেন। কিন্তু এই তারিখেও আদেশটি আসেনি।

অন্যদিকে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের কারণে ১২ আগস্ট মামলার আসামি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন না। তাদের পক্ষের আইনজীবী আদালতে সময় চেয়েছেন। আদালত আগামী ১২ নভেম্বর শুনানির দিন ধার্য করেছেন।

এই মামলার ৩২ জন আসামির মধ্যে জামিনে রয়েছেন ২১ জন। আর বাকি ১১ জন এখনো পলাতক রয়েছেন।

মামলা বাতিলের আবেদন করেন যেসব আসামিরা

ছাত্রাবাস পোড়ানো মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিনে থাকা আসামি সিলেট সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও বর্তমানে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাংশু দাস মিঠু, শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি আবু সরকার, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বর্তমান অ্যাডভোকেট আলমগীর হোসেন, কামরুল ইসলাম ও জ্যোতির্ময় দাস সৌরভ মামলাটি কোয়াশমেন্টের (বাতিল) জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি বিচারপতি মো. রিয়াজুল হক ও জাফর আহমদের যৌথ বেঞ্চ মামলাটি ৬ মাসের জন্য স্থগিত করেন। একইসঙ্গে মামলাটি কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে রুল ইস্যু করেন। ৬ মাসের মধ্যে উচ্চ আদালতে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

মামলার তথ্য নেই অনলাইনে

এদিকে মামলাটি ৬ মাস স্থগিত করে উচ্চ আদালতের এই রুলের জবাব রাষ্ট্রপক্ষ দিয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি উচ্চ আদালত থেকে আরেকটি আদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই আদেশের কোনো তথ্য নেই অনলাইনে। এমনকি নিম্ন আদালতেও অর্থাৎ সিলেটের আদালতেও এ সংক্রান্ত কোনো আদেশ আসেনি।

সিলেটের আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতের প্রতিটি মামলা অনলাইনে থাকে। কিন্তু নিম্ন আদালতের যেসব মামলা বিচারাধীন থাকে সেগুলোর তথ্য অনলাইনে সংরক্ষিত থাকে। এমসি কলেজ ছাত্রাবাস পোড়ানোর মামলাটি এখনো চার্জগঠন প্রক্রিয়ায়ও যায়নি।

মামলা প্রসঙ্গে যা বলছেন আইনজীবীরা

এ প্রসঙ্গে সিলেটের বিশিষ্ট আইনজীবী এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন, উচ্চ আদালতের আদেশ আনার দায়িত্ব হলো পাবলিক প্রসিকিউটরের। পাবলিক প্রসিকিউটর অফিস উচ্চ আদালতের সঙ্গে যোগাযোগ করে আদেশটি আনার কথা। এটা যদি তারা না করে থাকেন, তাহলে তাদের ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তৎকালীন এটর্নি জেনারেল অফিস ও সিলেটের পাবলিক প্রসিকিউটর অফিসের যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাদেরকেও ধরে নেওয়া হবে এই মামলার বিচারকার্য প্রলম্বিত করার ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই কাজ করেছেন। এটার সঠিক তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পোড়ানো ও ছাত্রাবাসে এক নারীকে ধর্ষণ এই দুই ঘটনা তখন সমাজে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই দুটি ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে, আমাদের প্রত্যাশা হবে অতি দ্রুত নতুন পিপি অফিস ও এটর্নি জেনারেল অফিস থেকে তৎপর হয়ে উচ্চ আদালত থেকে এটি সংগ্রহ করা এবং দ্রুত বিচারকার্য সম্পন্ন করা।

সিলেট জজকোর্টের অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, কোয়াশম্যান্টে কোনো উল্লেখযোগ্য বিষয় থাকলেও উচ্চ আদালত মামলাটি বাতিল করে দিতে পারেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষ অথবা মামলার কোনো সাক্ষিও চাইলে মামলাটি পুনরায় আপিল করে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবেন।

তবে এ বিষয়ে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট নওশাদ আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি সিলেট জেলা ও দায়রা জজ আদালতে কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

যা ঘটেছিল সেসময়

২০১২ সালের ৮ জুলাই সন্ধ্যায় ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষের পর জ্বালিয়ে দেওয়া হয় শত বছরের পুরনো মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রবাস। পুড়ে যায় হোস্টেলের প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ ব্লক।

এ ঘটনায় হোস্টেলের হল সুপার বশির আহমদ বাদী হয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের শাহপরান থানায় ২০১২ সালের ১৩ জুলাই মামলা দায়ের করেন। তদন্ত চলাকালে আরও দুটি মামলা হয় আদালতে। এ দুটি মামলাও বশির আহমদের দায়ের করা মামলার সঙ্গে নথিভুক্ত করা হয়।

আলোচিত এ মামলার রহস্য উদঘাটন করতে আদালতের নির্দেশে প্রথমে তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সিআইডি। কিন্তু আদালত এ প্রতিবেদন গ্রহণ না করে আবার তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর আবার তদন্ত করে ২০১৫ সালের ৯ আগস্ট ফের আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয় সিআইডি। ওই প্রতিবেদনও আদালত গ্রহণ না করে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু পিবিআইও গ্রহণযোগ্য প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হয়। এরপর চলতি বছরের ৩১ মে বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেন তৎকালীন সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে সারাবন তহুরা।

ঘটনার পাঁচ বছর পর ২০১৭ সালে ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে সিলেটের মহানগর বিচারিক হাকিম আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এ প্রতিবেদনের শুনানি শেষে সিলেটের তৎকালীন অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর বিচারিক হাকিম উম্মে সরাবন তহুরা দায়ী ২৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন।

এফএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।