বাসাভাড়া দিতে হিমশিম খাওয়া আবু জাহির এখন কয়েকশো কোটি টাকার মালিক

সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন
সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন হবিগঞ্জ
প্রকাশিত: ১০:১৩ এএম, ৩১ আগস্ট ২০২৪
আবু জাহিরের বিলাসবহুল বাড়ি

থাকতেন একটি টিনশেড ভাড়া বাসায়। পেশায় ছিলেন আয়কর উপদেষ্টা (আয়কর আইনজীবী)। রাজনীতিতে সর্বদা সক্রিয় থাকায় পেশায় মনোযোগী হতে পারেননি। আয়ও তেমন ছিল না। কখনো কখনো বাসা ভাড়া দিতেও হিমশিম খেতেন। অথচ এখন কী নেই তার। বিলাসবহুল ৬তলা বাড়ি, একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি ও আড়াইশো ভরি সোনার মালিক তিনি। সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বাড়ি, জমি দখলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত পটু। তার হাত থেকে মার্কেট, বাড়ি কিছুই রেহাই পায়নি। এমন নানান চাঞ্চল্যকর তথ্য এখন মানুষের মুখে মুখে ভেসে বেড়াচ্ছে। তিনি আর কেউ নন, হবিগঞ্জের সাবেক এমপি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবু জাহির।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, শহরে অসংখ্য বাড়ি, জমি সাবেক এমপি আবু জাহির দখল করেছেন। সরকারি, ব্যক্তি মালিকানাধীন কোনো জায়গাই তিনি ছাড়েননি। স্কুলের কোয়ার্টার, মার্কেট পর্যন্ত দখল করেছেন। যে ব্যক্তি ভাড়া বাসায় থেকে ঠিকমতো ভাড়া পরিশোধ করতে পারতেন না, তিনি এখন কয়েকশো কোটি টাকার মালিক। বৈধ আয় দিয়ে এটি কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। এগুলো তদন্ত হওয়া দরকার বলে তারা দাবি করেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মো. আবু জাহিরের রাজনীতি শুরু হয় ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি দিয়ে। কিছুদিন পরই যোগ দেন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি সবই হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। দলও ক্ষমতায় আসে। সেই থেকেই তার উত্থান শুরু।

কিছুদিনের মধ্যেই টাউন হল রোডে একটি পুকুরের জমি বিক্রি করে দেওয়ার শর্তে মালিক তাকে ৮.৫ শতাংশ জমি দান করেন। মাটি ভরাট করে সেখানে বাড়ি নির্মাণ করেন ২০০১ সালের দিকে। একতলা বাসায় থাকতেন।

২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বৈদ্যের বাজারে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় আহত হন। এরপরই তার কপাল খুলে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন এমপি মো. আবু জাহির হবিগঞ্জ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতি হন। তখনই তিনি স্কুলের ভবন এবং মার্কেট নিজের আয়ত্বে নেন। স্কুলের প্রায় ২৫ লাখ টাকা খরচ করে ভবন এবং মার্কেট সংস্কার করে এগুলো নিজের ভাইকে ভাড়া হিসেবে দেন। ভাড়া ধার্য্য করা হয় বাসা এবং দু’টি দোকান সব মিলিয়ে ৯ হাজার টাকা। অথচ এগুলোর বাজারমূল্য হিসাব করলে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা একেকটির ভাড়া হওয়ার কথা।

এরপর ক্রমান্বয়েই তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। টানা ১৬ বছর এমপি থাকার সুবাদে শহরের সার্কিট হাউজ রোডে শায়েস্তানগর এলাকায় একজন প্রবাসীর প্রায় ৭৫ লাখ টাকা মূল্যের একটি বাসা দুইজনের বিরোধের সুযোগে সালিশের নামে দখল করে নেন মো. আবু জাহির। তেঘরিয়া পিডব্লিউডি অফিসের পাশে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আরেক জনের ৩০ শতাংশ জমি দখল করেছেন। ওই জমির মূল্য প্রায় ৬ কোটি টাকা। হবিগঞ্জ হাইস্কুলের কোয়ার্টার ও মার্কেট প্রভাব খাটিয়ে দখল করেছেন। পুরাতন খোয়াই নদীর কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জমি দখল করে সেখানে সেলুন পট্টি করেছেন। নিজের বাসাটিকে বিলাসবহুল ৬তলা বিশিষ্ট বাড়ি করেছেন। বিলাসবহুল ৩টি জিপ গাড়িও কিনেছেন। মালিক হয়েছেন আড়াইশো ভরি সোনার।

বাসাভাড়া দিতে হিমশিম খাওয়া আবু জাহির এখন কয়েকশো কোটি টাকার মালিক

হবিগঞ্জ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের পেছনের পুকুরের ১৮ শতাংশ জমি স্ত্রীর নামে করেছেন। বাল্লা সীমান্তে স্ত্রী আলেয়া আক্তার, ছেলে ইফাদ জামিল, ভাই বদরুল আলম, ভাতিজা সাইদুর রহমান এবং নিজের পিএস সুদ্বীপ দাসের নামে ২০০ শতাংশ জমি কিনেছিলেন শত কোটি টাকা মূল্যে। বাল্লা স্থলবন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হলে চারগুণ মূল্যে সরকারের কাছে এ জমি বিক্রি করেন। শহরের রেলওয়ে বাইপাস সড়কে ঈদগার পাশে এক কানাডা প্রবাসীর ৩০ শতাংশ জমি দখল করেন। ওই জমির মূল্য অন্তত ১০ কোটি টাকা।

শাহজাহান মিয়া নামে একজন বলেন, হবিগঞ্জের এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে আবু জাহিরের জায়গা বা বাসা নেই। তিনি অসংখ্য বাসা দখল করেছেন। অলিপুরে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের একটি জায়গা দখল করেছেন। কোটি কোটি টাকা তারা বিদেশে পাচার করেছেন। হবিগঞ্জ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের বাসা এবং দোকান দখল করে তার ভাই বদরুলকে দিয়েছেন।

একে হবিগঞ্জ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালাম জানান, তিনি শুধু পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দায়িত্ব পেয়েছেন। পূর্বের অধ্যক্ষ আবুল লেইছ অবসরে চলে গেছেন। তিনি কোনো খাতাপত্র বুঝিয়ে দেননি। এমনকি অধ্যক্ষের কক্ষটিও তালা দিয়ে চাবি নিয়ে গেছেন। যে কারণে আসলে আমার পক্ষে তেমন তথ্য দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া স্কুলের সভাপতি সাবেক এমপি মো. আবু জাহিরের স্ত্রী আলেয়া আক্তারও এলাকায় নেই। তার সঙ্গে যোগাযোগও করা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, বর্তমানে বাসা ভাড়া ৩ হাজার এবং মার্কেটের একেকটি দোকানের ভাড়াও ৩ হাজার টাকা করে পরিশোধ করছেন। এগুলো সংস্কারে কত ব্যয় হয়েছে তা আমার জানা নেই। খাতাপত্র বুঝে পেলে এটি বলতে পারবো।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, বিগত দিনে প্রভাবশালীরা পুরাতন খোয়াই নদীটিকে যেভাবে দখল করেছেন, দোকানপাট তৈরি করেছেন, ব্যবসা বাণিজ্য করেছেন এতে নদীর অস্তিত্ব একেবারেই বিপন্ন হতে চলেছে। আমরা মনে করছি দ্রুততার সঙ্গে যদি পুরাতন খোয়াই নদী উদ্ধার না করা হয়, তাহলে হবিগঞ্জে মানবিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।

এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।