ধ্বংসস্তূপ গাজী টায়ার কারখানা, মরদেহের অপেক্ষায় স্বজনরা
নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন রূপগঞ্জের টায়ার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গাজী টায়ার্স কারখানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। টানা ৩২ ঘণ্টার আগুনে সেখানে কিছু ইঞ্জিন আর ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা ছাড়া কিছুই নেই। আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ভবন ও লোহার অবকাঠামোও যে কোনো সময় ধসে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আগুনের সময়ে ভেতরে আটকে পড়া লোকজনেরও এখন পর্যন্ত কোনো সন্ধান মিলছে না। আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ভবন ও লোহার অবকাঠামো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় সেখানে উদ্ধার অভিযান চালাতে পারছেন না ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ৪৫ একর জায়গাজুড়ে কারখানাটির অবস্থান। ভেতরে শেডসহ অন্তত ১৬টি স্থাপনা রয়েছে। ২০০২ সালে কারখানাটির উৎপাদন শুরু হয়। কারখানাটিতে দেশে উৎপাদিত রাবার থেকে রিকশা, বাস, ট্রাক, পিকআপ ও অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনের টায়ার তৈরি হতো।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
গাজী টায়ার্স কারখানার মালিক গোলাম দস্তগীর গাজী রোববার (২৫ আগস্ট) ভোরের দিকে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেফতার হন। তাকে গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়লে সোমবার দুপুরে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন কারখানার ভেতরে ঢুকে লুটপাট শুরু করেন। বিকেল ৪টার দিকে বরাব এলাকা থেকে একটি গ্রুপ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসে পুরো কারখানার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে।
এনিয়ে আগে থেকেই লুটপাট চালানো দুর্বৃত্তদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। পরে অস্ত্রধারীরা পিছু হটে। রাত ৯টার দিকে বিদ্যুৎহীন অন্ধকার ছয়তলা ভবনটিতে শত শত লোক লুটপাট চালাতে থাকেন। এসময় কে বা কারা ভবনের নিচতলায় সিঁড়ির মুখে আগুন দিয়ে দেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা টানা ৩২ ঘণ্টা ধরে চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে কারখানার ভেতরে থাকা সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
নিখোঁজের সংখ্যা নিয়ে গড়মিল
আগুন লাগার পর কারখানার ভেতরে আটকে পড়া লোকদের স্বজনদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নিখোঁজদের তালিকা করা হয়। ১৭৫ জনের একটি তালিকা করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। তবে পরে ফায়ার সার্ভিস তালিকা তৈরির বিষয়টি অস্বীকার করে। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে নিখোঁজদের তালিকা করা হয়।
শিক্ষর্থীদের পক্ষ থেকে তালিকা করা মাহিমা মিম লিপা বলেন, ‘নিখোঁজদের তালিকা নিয়ে গড়মিল হওয়ায় আমরা মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) তালিকা করা শুরু করি। গতকাল আমরা ১২৯ জনের তালিকা করেছি। আজ নতুন করে তিনজনের নাম পেয়েছি। সবমিলিয়ে আমাদের কাছে ১৩২ জনের তালিকা রয়েছে।’
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্টেট হামিদুর রহমান বলেন, ‘যারা এখানে এসে বলছেন তাদের স্বজনরা নিখোঁজ রয়েছেন, আমরা তাদের তালিকা লিপিবদ্ধ করে রাখছি। তবে নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না কতজন ভেতরে ছিলেন বা মারা গেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তাদের ড্রোন কিংবা মই দিয়ে দেখেছেন কোনো ডেড বডি (মরদেহ) নেই। আমরা মনে করছি যেহেতু এখানে অনেক কেমিক্যাল পোড়ানো হয়েছে, কোনো মানুষ যদি থেকেও থাকে তাহলে সেটা ওইভাবে ডেড বডি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ ২১ থেকে ২২ ঘণ্টা টানা আগুন জ্বলছিল। সে হিসেবে নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না।’
জীবিত নয় মরদেহের অপেক্ষায় স্বজনরা
সরেজমিন দেখা গেছে, কারখানার বাইরে নিখোঁজদের স্বজনরা মরদেহের খোঁজ করছেন। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তাদের ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। বাইরে থেকেই শেষ সম্বল হিসেবে তারা মরদেহের অপেক্ষায় রয়েছেন।
রূপগঞ্জের বাসিন্দা আল-আমিন এসেছেন তার চাচাতো ভাই মিজানের মরদেহের খোঁজে। তিনি বলেন, ‘আমার চাচাতো ভাই মিজান প্রবাসে ছিল। কিছুদিন আগে মালয়েশিয়া থেকে এসেছে। আগুন লাগার খবর শুনে এখানে দেখতে এসেছিল। কিন্তু এরপর থেকেই সে নিখোঁজ রয়েছে। এভাবে আমাদের এলাকারই ছয়জন নিখোঁজ রয়েছে। তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।’
কারখানার গেটের কাছে কান্না করছিলেন নুরবানু বেগম। তিনি তার ছেলে নুর আলমের খোঁজে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার তিন ছেলের মধ্যে এই ছেলেটাই আমার দেখাশোনা করতো। কারখানায় আগুন লাগছে শুনে দেখতে এসেছিল। এরপর থেকেই সে নিখোঁজ রয়েছে। তার একটি মেয়ে রয়েছে। এখন তার মেয়েকে কে দেখবে আর আমাকেই কে দেখবে?’
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান বলেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো বাইরের ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে ভেতরের বিষয়গুলো চিহ্নিত করার। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, শতাধিক মানুষ ভেতরে ছিলেন। কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই। এখানে যদি একজন মানুষও থেকে থাকে আমরা সেটা গুরুত্ব দিয়ে দেখবো। আমাদের মূল প্রচেষ্টা হলো ভেতরের অবস্থা জানা।
বন্ধ হয়নি লুটপাট
এখনো কারখানার ভেতরে ও বাইরে লুটপাট চলছে। স্বজনদের খোঁজে এসে লোকজন সুযোগ পেলেই লুটপাট করছেন। কারখানার ভেতরে অবশিষ্ট থাকা ভারী ইঞ্জিন ও বাইরে পড়ে থাকা বিভিন্ন মালামাল লুটপাটের চেষ্টায় রয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
কারখানার নিরাপত্তায় দায়িত্বে থাকা ইয়াকুব বলেন, ‘মানুষের লুটপাট বন্ধ হচ্ছে না। ৫ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে, এখনো লুটপাট করেই যাচ্ছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। তারপরও লুটপাট বন্ধ হয়নি। আমরা বাধা দিলে আমাদের মারধর করে।’
তিনি আরও জানান, কারখানাটিতে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। অগ্নিকাণ্ডের পর তাদের কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেছে।
তদন্ত কমিটির সদস্যরা যা বলছেন
আগুনের ঘটনাসহ সার্বিক বিষয়ে তদন্ত করার জন্য আট সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে রয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান। অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার, ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি, গণপূর্ত এবং বিদ্যুতের প্রতিনিধিরাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কমিটির সদস্য। তারা বুধবার বিকেলে কারখানা সরেজমিন পরিদর্শন করেন।
তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান বলেন, ‘তদন্ত কমিটির সদস্যদের নিয়ে আমরা প্রাথমিকভাবে পরিদর্শন করেছি। পরবর্তী সময়ে প্রতিবেদন আকারে জানাতে পারবো। ভবনের বিষয়ে স্থানীয়ভাবে যারা আছেন তারা ভেতরে কোনো কাজ চালাতে পারবেন কি না, (সে বিষয়ে) টেকিনিক্যাল পারসনরা আমাদের মতামত দেবেন। আর যদি উনারা মনে করেন উনারা পারবেন না, তাহলে জাতীয়ভাবে কোনো সাপোর্টের প্রয়োজন আছে কি না সেটাও আমরা জানাবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ১০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার চেষ্টা করবো। তবে প্রাথমিকভাবে আমাদের ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ড্রোন দিয়ে দেখেছেন ভবনের ৪, ৫ ও ৬ তলার ফ্লোর ধসে পড়েছে।’
মোবাশ্বির শ্রাবণ/এসআর/জিকেএস