আহতদের ভাষ্য
শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পরও বিজয় মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ
পেশায় একজন রাইডার সুলতান আহমদ। তিনি সিলেটের গোয়াইনঘাটের পান্থুমাই গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে। স্থানীয় সোনারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। গত ৫ আগস্ট গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরে বিজয় উল্লাসের সময় গুলিবিদ্ধ হন সুলতান। বর্তমানে তিনি সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।
বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) বিকেলে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় সুলতানের। গুলির আঘাতের যন্ত্রণায় হাসপাতালের শয্যায় এখনো ছটফট করছেন তিনি। এ প্রতিবেদককে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করেও পারেননি। সেই শক্তিটাও নেই তার।
সুলতান আহমদ বলেন, ‘কোটা আন্দোলনের শুরু থেকেই প্রতিদিন বিভিন্ন মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্মম নির্যাতনের খবর দেখি। ক্ষোভে ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু পুলিশের অতর্কিত গুলির ভয়ে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। ৫ আগস্ট দুপুরের পর থেকে যখন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে, তখন চারদিক থেকে গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরে মানুষ আসতে শুরু করেন। নানা শ্রেণিপেশার শত শত মানুষের সঙ্গে আমিও যোগ দিই বিজয় মিছিলে। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মিছিলের মাঝখানে থাকা অবস্থায় হঠাৎ তিনটি এসে লাগে। দুটি গুলি একপাশ দিয়ে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু পেটে যে গুলিটি লাগে সেটি ভেতরেই থেকে যায়।’
তিনি বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমাকে প্রথমে গোয়াইনঘাট উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার করে পেটের ভেতর থেকে গুলিটি বের করেছেন।’
সুলতানের পাশের শয্যায় একইভাবে ছটফট করছিলেন ৩০ বছর বয়সী রায়হান আহমদ। বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার দোহারি গ্রামে। পেশায় দিনমজুর রায়হানের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ৫ আগস্ট বিকেলে বাড়ি থেকে হাটে যাওয়ার পথে তিনিও পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন।
রায়হানের সঙ্গে থাকা তার মা হামিদা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো আন্দোলনে জড়িত ছিল না। ৫ আগস্ট বিকেলে হাটে যাওয়ার পথে পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহত হয়। গুরুতর অবস্থায় তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রায়হান পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে। একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। তবে আমার ছেলে এখনো পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন ডাক্তাররা।’
হাসপাতালের ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি অসংখ্য রোগীদের মধ্যে কোটা আন্দোলনের সময় আহতদের আলাদাভাবে রাখা হয়েছে। একটি সারির একেবারে শেষ প্রান্তের শয্যায় শুয়ে আছেন রুবেল আহমদ (৩২)। দূর থেকে মনে হয়েছিল এ প্রতিবেদককে কিছু বলতে চাচ্ছেন। কিন্তু পাশে যেতেই দেখা যায় তিনি এভাবেই আনমনা হয়ে তাকিয়ে আছেন। বুক, পিটে ও হাত ছররা গুলির আঘাতে জর্জরিত রুবেল কারও সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না।
রুবেল সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার মোল্লাপাড়া গ্রামের তমিজ আলীর ছেলে। তিনি পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। গত ৪ আগস্ট সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ এলাকায় পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হন।
রুবেলের পাশে বসা তার ভাগনি কথা বললেও নিজের নাম প্রকাশ করেননি। তিনি বলেন, তার মামা সেদিন কাজের সুবাদে ওই এলাকায় ছিলেন। ৪ আগস্ট ঢাকা দক্ষিণে পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের সময় একটা মেয়ে শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। এই শিশুটিকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করার সময় তিনিও গুলিবিদ্ধ হন। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয়রা তাকে হাসপাতালে এনে ভর্তি করেছেন।
তিনি আরও বলেন, রুবেলের একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, আরও একটি অস্ত্রোপচার লাগতে পারে। এখনো শঙ্কামুক্ত বলা যাচ্ছে না। সুস্থ হতে আরও অনেক সময় লাগবে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের খবর পেয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে মিছিলে গিয়েছিলেন মিজান মিয়া (২৩)। পুলিশের গুলিতে তার বাম পায়ের হাড় আঘাতপ্রাপ্ত হয়। সুনামগঞ্জের হালুয়ারঘাটের বাসিন্দা মিজান চিকিৎসাধীন রয়েছেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের ১০ নম্বর বেডে।
মিজানের মা মজিদা বেগম বলেন, হাসপাতাল বিনামূল্যে চিকিৎসা হওয়ায় প্রাণে বেঁচেছি। অনেক মানুষ দেখতে এসে সহযোগিতা করে গেছেন। তার ছেলের মতো যারা পুলিশের গুলিতে নিহত ও আহত হয়েছেন, তাদের ঘাতকদের বিচার দাবি জানান তিনি।
সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্ত্তী বলেন, আন্দোলনের সময় আহত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তারা সবাই গুলিবিদ্ধ। আমরা প্রথম থেকেই সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছি। তাদের চিকিৎসার জন্য আলাদা মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকা তিনজনের মধ্যে একজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। বাকি দুজনের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।
আহমেদ জামিল/এসআর/এএসএম