আত্মগোপনে নীলফামারীর এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সোমবার (৫ আগস্ট) দুপুরে দেশত্যাগ করে ভারতে যান তিনি। এরপর থেকে আতঙ্কে রয়েছেন দলটির নেতাকর্মী ও মন্ত্রী-এমপিরা। নীলফামারীতেও একই অবস্থা। জেলার আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতার মোবাইল বন্ধ। বাড়িতেও কাউকে পাওয়া যায়নি।
এরই মধ্যে তাদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন নেতাকর্মী-সমর্থকরা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে নীলফামারীর সংসদীয় চারটি আসনের তিনটিতেই আধিপত্য ছিল আওয়ামী লীগের।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নীলফামারী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দীন সরকারের কোনো খোঁজ মিলছে না। তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা মার্কা নিয়ে টানা তৃতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সবশেষ ৪ আগস্ট তাকে ডিমলার বাড়িতে দেখা যায়। পরদিন ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যান। এরপর বিক্ষুব্ধ জনতা আফতাব উদ্দীনের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনার আগেই তিনি আত্মগোপনে চলে যান বলে ধারণা স্থানীয়দের।
অনেকে ধারণা করছেন, তিনি লালমনিহাটের পাটগ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে একদিন অবস্থান করে বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে ভারত চলে গেছেন।
এদিকে নীলফামারী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূরের খোঁজ মিলছে না। তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা মার্কা নিয়ে টানা পঞ্চমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সবশেষ ১৬ জুলাই নীলফামারী যান তিনি। এরপর ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী সবুজ আলীর জানাজায় অংশগ্রহণ করে ঢাকায় ফিরে যান।
একটি সূত্র বলছে, সেখান থেকে তিনি লন্ডনে মেয়ের কাছে চলে গেছেন। এদিকে ৪ আগস্ট তার নীলফামারীর বাড়িতে ভাঙচুর ও ৯টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা।
নীলফামারী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন পাভেলও নেই তার এলাকায়। তিনি এখন কোথায় আছেন তা জানেন না স্থানীয় নেতারা।
তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, সাদ্দাম হোসেন পাভেল ঢাকায় রয়েছেন। এদিকে শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর দুর্বৃত্তরা তাকে না পেয়ে তার গাড়ি চালকের ওপর হামলা চালান। তিনি এখন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
নীলফামারী-৪ আসনের স্বতন্ত্র সাবেক এমপি ও জাতীয় পার্টির জেলা কমিটির সাবেক সদস্য মো. সিদ্দিকুল আলম সিদ্দিক মুঠোফোনে বলেন, আমার মা অসুস্থ, আমি ঢাকায় একটি হাসপাতালে রয়েছি। মা সুস্থ হলে এলাকায় ফিরে যাবো। আমি কোথাও পালাবার লোক নই। জনগণের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো।
শুধু সংসদ সদস্যরাই আত্মগোপন করেছেন, এমনটা নয়। নীলফামারী জেলা ও জেলার ছয় উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতা এবং অঙ্গসংগঠনের সবাই আত্মগোপনে। এখন দলীয় নেতাকর্মীদের বেশির ভাগই অবস্থান পরিবর্তন করার পাশাপাশি বন্ধ রেখেছেন মুঠোফোন নম্বর। এ কারণে দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এরমধ্যে নীলফামারী পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দেওয়ান কামাল আহমেদ নেতাকর্মীদের রেখে নিরাপদ স্থানে রয়েছেন। এখন পর্যন্ত তাকে মাঠে দেখেননি কর্মী-সমর্থকরা। তার বাড়িতেও ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা।
নাম না প্রকাশের শর্তে অনেকেই বলেছেন, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি তৃণমূল কর্মীদের এতদিন যে আস্থা ছিল, তা এখন আর নেই। তাদের কেউই কল্পনা করতে পারেননি শেখ হাসিনা এভাবে পালিয়ে যাবেন। এমন পরিস্থিতিতে তাদের মনোবল ভেঙে গেছে। একই সঙ্গে শেখ হাসিনা যে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন সেটাও কেউ কল্পনা করেনি বলে মনে করছেন।
চলতি বছরে জানুয়ারি মাসে টানা চতুর্থবারের মতো নতুন সরকারের ক্ষমতা নেন শেখ হাসিনা। দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতায় থেকেও ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমাধান করতে পারেনি হাসিনা সরকার। একের পর এক বিতর্কিত বক্তব্য ও ভুল সিদ্ধান্তের ফলে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ে। যা সামাল দিতে না পেরে বাধ্য হয়ে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা।
৫ আগস্ট দেশ ছাড়ার আগে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রেকর্ড করার অনুমতি চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। এদিন দুপুর আড়াইটার দিকে গণভবন থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে করে ‘নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে’ পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এ সময় সঙ্গে ছিলেন ছোটবোন শেখ রেহানা। দেশ ত্যাগের পরই ক্ষিপ্ত জনতা গণভবনে প্রবেশ করেন।
নীলফামারী জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট ফারুক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, এই স্বৈরশাসক দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে জনগণকে কোণঠাসা করে রেখেছিল। ভয়ে জনগণ মুখ খুলতে পারেনি। ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটাকে আবার স্বাধীন করেছে। এ বিজয় ধরে রাখতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
ইব্রাহিম সুজন/জেডএইচ/জেআইএম/এমআইএইচএস