সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে টাকায় মেলে জখমি সনদ

এম এ মালেক
এম এ মালেক এম এ মালেক , জেলা প্রতিনিধি, সিরাজগঞ্জ
প্রকাশিত: ১২:০৪ পিএম, ০১ আগস্ট ২০২৪

সিরাজগঞ্জে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে টাকা দিলেই মেলে ভুয়া জখমি সনদ। এতে জেলার ১১টি থানায় সামান্য ঘটনায়ও মামলার হাতিয়ার হিসেবে গুরুতর জখমি সনদের ব্যবহার বাড়ছে। অনৈতিক এ সনদ বাণিজ্যের ফাঁদে পড়ে মিথ্যা মামলায় সীমাহীন হয়রানি ও জেল-জরিমানার মুখোমুখি হচ্ছেন নিরীহ মানুষ।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সিরাজগঞ্জে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের এক শ্রেণির অর্থলোভী চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এ জাতীয় সনদ দেওয়া হচ্ছে। উপযুক্ত তদারকি ও শাস্তি না পাওয়ায় সনদ কেনাবেচার সংঘবদ্ধ চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

হাসপাতালের মেডিকেল রেকর্ড সেন্টারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের ১ জুন থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত ৮৭টি জখমি সনদ প্রদান করেছেন চিকিৎসকরা। আর গত ছয় মাসে এ সনদ প্রদানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচশো।

সরেজমিনে জানা যায়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তির সময় মোটা অঙ্কের টাকা দিলেই গুরুতর জখম দেখিয়ে ভর্তি করে গ্রিভিয়াস (গভীর ক্ষত) সনদ দেওয়া হয়। এছাড়া হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ ও ভেতরে ওঁত পেতে থাকেন এ সনদ চক্রের সদস্যরা। সংঘর্ষ অথবা নির্যাতনে কেউ আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেই তারা প্রথমে সহযোগিতার কথা বলে রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে খাতির জমান। একইসঙ্গে মামলা করার ইচ্ছা আছে কিনা জানতে চাওয়া হয়। পরে মেডিকেল সনদ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে চুক্তি করেন।

মূলত মেডিকেল ইনজুরি সার্টিফিকেট দুই ধরনের- সাধারণ ও গুরুতর। এসব সার্টিফিকেট ভেদে সর্বনিম্ন দুই হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা নেয় চক্রটি। পরে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে টাকা দিয়ে তারা সনদ সংগ্রহ করেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছরের ২০ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে জেলার বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের ফকিরপাড়া এলাকায় এবিএম ওসমান গণি সরকার নামের এক বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্পত্তি জোরপূর্বক দখল করাকে কেন্দ্র করে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের উপস্থিতিতে দু’পক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের চার থেকে পাঁচজন আহত হন। ওই সময় ফজলার রহমান রুমু বীর মুক্তিযোদ্ধার এক ছেলের চোখে সজোরে ঘুষি মারেন। ঘুষি মেরে তিনি নিজেই মাটিতে পড়ে যান। এতে পাশে থাকা একটি লাউয়ের মাঁচায় তার চোখের ভুরুর ওপরের অংশে একটু চামড়া উঠে যায়। পরে এক পল্লি চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ব্লেড দিয়ে হালকা কেটে ছয়টি সেলাইও করেন তিনি।

হাসপাতাল, মামলা, প্রতারণা, সংঘর্ষসিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে টাকায় মেলে জখমি সনদ

এর চার ঘণ্টা পর ফজলার রহমান নিজেই সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে টাকা দিয়ে সনদ নেওয়ার চুক্তিতে ভর্তি হন। এরপর হাসপাতালে ভর্তি দেখিয়ে বাড়িতে চলে যান। পরদিন আবারও ওই হাসপাতালে গিয়ে নিয়মিত উপস্থিতি দেখান ফজলার। একইসঙ্গে গ্রিভিয়াস সনদ সংগ্রহ করেন।

এরপর এ ঘটনায় ফজলার রহমানের ছোট ভাই হিরণ প্রামাণিক বাদী হয়ে ৩২৬ ধারায় বেলকুচি থানায় পাঁচজনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এ মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, প্রতিপক্ষ ধারালো হাসুয়া দিয়ে ফজলার রহমানের কপালে কোপ দিয়েছে।

অথচ এই ঘটনার সময় স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী কোনো ধরনের অস্ত্রই ব্যবহার হয়নি।

এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় মাহমুদুল মুন্সী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওই ঘটনার সময় আমিসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলাম। মূলত ফজলার রহমান ওই সময় অতিরিক্ত রেগে প্রতিপক্ষের একজনের চোখে ঘুষি মেরে নিজেই হালকা আঘাত পেয়েছিলেন। অথচ এ ঘটনায় টাকার বিনিময়ে হাসপাতাল থেকে গ্রিভিয়াস সনদ সংগ্রহ করে আদালতে জমা দেওয়ায় নিরাপরাধী একজনকে এক সপ্তাহ কারাগারে থাকতে হয়েছে।’

এ মামলার বিবাদী পক্ষের আইনজীবী নাসির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, এটি একটি পরিকল্পিত মিথ্যা মামলা। কারণ এ মামলার এজাহারের সঙ্গে মেডিকেল সনদের কোনো মিল নেই। মূলত ৩২৬ ধারাকে কার্যকর করতেই বাদীপক্ষ অর্থের বিনিময়ে হাসপাতাল থেকে এই ভুয়া গ্রিভিয়াস সনদ সংগ্রহ করেছিলেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এদিকে ফজলার রহমান রুমুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এ ঘটনায় আদালতে মামলা থাকায় আমি কোনো কথা বলতে পারবো না। কারণ এখন কিছু বললে আমার ভুল হতে পারে।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের আব্দুল মমিন নামের এক ভুক্তভোগী জাগো নিউজকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমার এক আত্মীয়ের প্রতিবেশীরা মারপিট করে মাথায় আঘাত করেন। এতে মাথার উপরিভাগে গভীর গর্ত হয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। পরে সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করি। পরেরদিন জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. ফয়সাল আহমেদ জানতে চান এ ঘটনায় আমরা মামলা করবো কিনা। উত্তরে হ্যাঁ বললে তিনি গ্রিভিয়াস সনদ দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা নেন এবং দুদিন পর সনদ দেওয়া হবে বলে জানান। এর দু’দিন পর সনদের জন্য গেলে তিনি আরএমও (আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা) ফরিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে তার কাছে গেলে তিনি আরও দুই হাজার টাকা নিয়ে গ্রিভিয়াস সনদ দেন।’

তবে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ফয়সাল আহমেদ এ অভিযোগ অস্বীকার করে জাগো নিউজকে বলেন, জখম না হলে গ্রিভিয়াস সনদ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর এ সনদ প্রদানে কোনো টাকা নেওয়া হয় না।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ও মেডিকেল বোর্ডের সভাপতি ডা. ফরিদুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে জাগো নিউজকে বলেন, জখমি সনদ মূলত জরুরি বিভাগের চিকিৎসকই লেখেন। দুজন সদস্য স্বাক্ষর দেওয়ার পর সভাপতি হিসেবে আমি শুধু স্বাক্ষর দিই। তবে এক্ষেত্রে কোনো আর্থিক লেনদেন হয় না বলে তিনি দাবি করেন।

হাসপাতালের তত্ত্বাধায়ক ডা. রতন কুমার রায় জাগো নিউজকে বলেন, এসব সনদের জন্য একটি মেডিকেল বোর্ড রয়েছে। তারাই মূলত এগুলো দেয়। তবে অর্থের বিনিময়ে এসব সনদ দেওয়া হয় কি না তিনি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান।

সিরাজগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. রামপদ রায় জাগো নিউজকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী কর্তব্যরত চিকিৎসকসহ তিন সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড এসব সার্টিফিকেট দেয়। এক্ষেত্রে টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে অবশ্যই সেটির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।