‘মাইয়াডা কইতেও পারলো না, আমার সন্তানরে চাইয়া রাইখো’
‘মা হইয়া আমি আমার মাইয়ারে বাঁচাইতে পারি নাই। আমার মাইয়াডা কইতেও পারলো না, আমার সন্তানরে চাইয়া রাইখো। আমার মাইয়াডা আর কিছু কইতে পারলো না।’ আহাজারি করে কথাগুলো বলছিলেন নিজ বাসার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করা সুমাইয়া আক্তারের (২০) মা আছমা বেগম।
গত ২১ জুলাই বাদ আছর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী নতুন মহল্লার দোয়েল চত্বর এলাকার একটি ফ্ল্যাটে এ ঘটনা ঘটে। ওইদিন সকাল থেকেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড় থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত উত্তাল ছিল। মহাসড়ক অবরোধকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ চলাকালে একটি গুলি বারান্দার গ্রিল ভেদ করে সুমাইয়ার মাথার বামদিক দিয়ে ঢুকে ডানদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন সুমাইয়া আক্তার।
ওই দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তার মা বলেন, ‘সেদিন আমি আছরের পর বারান্দায় দাঁড়াইয়া ছিলাম। গোলাগুলির আওয়াজ শুনে সবাই দেহাদেহি করতাছিল। ও (সুমাইয়া) তহন বারান্দায় আইসা কইলো সবাই দেহে, আমিও একটু দেহি। এরইমধ্যে হঠাৎ করে কী হইয়া গেছে তা আমি নিজেই কইতে পারি না। আমি হালকাভাবে একটু শব্দ পাইছিলাম। তহন চাইয়া দেহি মেয়ে আমার ঢইলা নিচের দিকে পইড়া গেছে। আমি তহন ভাবছি আতঙ্কে ওয় মনে হয় পইড়া গেছে। পরে মাথায় হাত দিয়া দেহি প্রচুর রক্ত বাইর হইতাছে। আমি হাত দিয়া রক্ত আটকাইনার চেষ্টা করলেও নাক, মাথা দিয়া রক্ত আটকাইনা যাইতাছিল না। আমি তখন চিৎকার করতে থাকি। আমার মেয়েরে বাঁচাও, বাঁচাও।’
সুমাইয়ার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই বছর আগে তার বিয়ে হয়। আড়াই মাস আগে তার প্রথম সন্তান সুয়াইবার জন্ম হয়। দুই মাস ধরে নবজাতককে নিয়ে তিনি মায়ের বাসায় ছিলেন। গত ২৭ জুলাই শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লায় চলে যাওয়ার কথা ছিল।
এর আগে আর্থিক সংকটের মধ্যেই করোনার সময় সুমাইয়ার বাবা সেলিম মাদবর মারা যান। তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে নিরুপায় হয়ে তার মা আছমা বেগম গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থেকে সন্তানদের নিয়ে চলে আসেন নারায়ণগঞ্জে। বড় ছেলে শাকিল গার্মেন্টে ও মেজ ছেলে সজল কার্টন ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। ছোট মেয়ে সুমাইয়া আক্তারও গার্মেন্টে কাজ করতেন। বাচ্চা হওয়ার পর তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তার স্বামী জাহিদ হোসেন সোনারগাঁয়ের কাঁচপুরে একটি গার্মেন্টে কাজ করেন। তিন বছরের বেশি সময় ধরে সুমাইয়ার পরিবার এই এলাকায় বসবাস করছেন।
বিলাপ করে নিহত সুমাইয়ার মা আছমা বেগম বলেন, ‘চোখের সামনে মাইয়াডা শেষ হয়ে গেলো। আমার স্বামী করোনার সময়ডায় মারা গেছে। তখন থেহে আমি সবাইরে আগলায় রাখছি। আড়াই মাস আগে মাতুয়াইল হাসপাতালে ওর বাচ্চা হইছিল। আমার মেয়েডা অসুস্থ ছিল, তাই ওরে আমার বাসায় নিয়া আইছিলাম। জামাই আমারে বিশ্বাস কইরা রাইখা গেছিল। সুস্থ হইয়া নিয়া যাইবো কইছিল। শনিবার এই ঘটে। শুক্রবার যাইতো গা। কেমনে যে আমার মেয়ের কী হইয়া গেলো আমি কিছুই কইতে পারলাম না। আল্লাহ তুমি আমার মেয়েডারে দেইখা রাইখো। আমার নাতিডার এখন কি হইবো? কেডায় ওরে এহন দেইখা রাখবো?’
নিহতের দুলাভাই মো. বিল্লাল বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর রক্ত ঝরছিল। তখন এই পরিস্থিতিতে তাকে নিয়ে কোথায় যাবো এ নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। পরে এখান থেকে নামিয়ে অটোরিকশা ভাড়া করে সাইনবোর্ডের প্রো অ্যাকটিভ হাসপাতালে নিয়ে যাই। ওইখানকার চিকিৎসক বলেন, উনি আর বেঁচে নেই। তাকে এখানে রেখে লাভ নেই। পরে এলাকাবাসীর সহায়তার সিদ্ধিরগঞ্জ পুলে তাকে দাফন করি। কিছুদিন পরই তার কুমিল্লায় চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আল্লাহ তার ভাগ্যে তা রাখলো না। এখনো বাচ্চাটার দিকে তাকালে সুমাইয়ার কথা মনে পড়ে যায়।
এফএ/জেআইএম