মামুন সেদিন বাড়িতে ফিরেছিলেন ঠিকই, তবে লাশ হয়ে

বিধান মজুমদার
বিধান মজুমদার বিধান মজুমদার , জেলা প্রতিনিধি, শরীয়তপুর
প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ২৯ জুলাই ২০২৪
ছবি: মামুন মিয়া

বাবা অসুস্থ। রাতে মুঠোফোনে ছেলে মামুন মিয়াকে বিষয়টি জানান মা হেনা বেগম। মামুন মাকে কথা দিয়েছিলেন, সকালে ফিরেই বাবাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবেন। সেদিন তিনি বাড়িতে ফিরেছিলেন ঠিকই, তবে লাশ হয়ে।

মামুনের এভাবে ফিরে আসাটা কেউ হয়তো কল্পনাও করেনি। কোটা আন্দোলনের ঘটনায় একটি বুলেট নিভিয়ে দেয় এই স্বপ্নবাজ তরুণের জীবন প্রদীপ। তার এমন মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শরীয়তপুর সদর উপজেলার শৌলপাড়া ইউনিয়নের চরচিকন্দি এলাকার আব্দুল গণি মাদবর ও হেনা বেগম দম্পতির চার ছেলের মধ্যে সবার ছোট মামুন মিয়া (২৫)। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ মেধাবী কৃষক পরিবারের ছেলেটি। তার স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া।

মামুন সেদিন বাড়িতে ফিরেছিলেন ঠিকই, তবে লাশ হয়ে

২০১৬ সালে স্থানীয় শৌলপাড়া মনোয়ার খান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৮ সালে শরীয়তপুর জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজে ভর্তি হন। সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকোত্তরে পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করতেন। নিজের খরচ যোগানোর পাশাপাশি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন পরিবারেরও। চাকরি নিয়ে আগামী ২২ আগস্ট মধ্য আমেরিকার দেশ বেলিজ যাওয়ারও কথা ছিল তার। তবে তার সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেলো।

প্রত্যক্ষদর্শী পারভেজ জানান, তিনি আর মামুনসহ বেশ কয়েকজন ঢাকার রামপুরা ওয়াবদা রোড এলাকায় একটি ভাড়ার বাসায় থাকতেন। গত ১৮ জুলাই রাত ১২টার দিকে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে বাসা থেকে নিচে নেমে আসেন ৫ বন্ধু। এরপর তারা কিছুক্ষণ গলির মধ্যে হাঁটাহাঁটি করেন। এক সময় মামুন তাদের থেকে একটু সামনে গলির মাথায় চলে যান। কিছুক্ষণ পরই গোলাগুলি শুরু হলে দৌড়ে পালানোর সময় একটি বুলেট তার মাথায় ঢুকে বের হয়ে যায়। বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরো সায়েন্স ও হাসপাতালে নিয়ে যান। পরের দিন শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়ির উঠোনভর্তি মানুষ। মা হেনা বেগম ঘরের বারান্দার একটি খুঁটি ধরে আহাজারি করেছিলেন। তাকে সান্ত্বনা দিতে ছুটে এসেছেন প্রতিবেশীরা। বাবা আব্দুল গণি মাদবর অসুস্থ। একটু কান্না করতেই আবার নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকেন।

মামুন সেদিন বাড়িতে ফিরেছিলেন ঠিকই, তবে লাশ হয়ে

আহাজারি করতে করতে মামুনের মা হেনা বেগম বলেন, ‘আমার পোলায় কইছিলো সকালে আইসা ওর বাপেরে ডাক্তারের কাছে নিয়া যাইবো। কিন্তু আল্লাহ এইডা কী করলো। আমার পোলায় যে লাশ হইয়া ফিরলো। আমি কীভাবে আমার বাপরে ভুলমু।’

মামুনের বড় ভাই রুবেল বলেন, মামুন অনেক মেধাবী ছিল। ও নিজের প্রচেষ্টায় এতদূর এসেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইনে কাজ করে রোজগার করতো। ওর আয়ের ওপর আমাদের পরিবার নির্ভরশীল ছিল। এখন আমাদের পরিবারটা কীভাবে চলবে জানি না। আমার ভাইয়ের মতো এমন মৃত্যু যেন আর কারো না হয়, সরকারের কাছে এটাই দাবি।

শৌলপাড়া মনোয়ার খান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোতালেব হোসেন বলেন, মামুন ছেলেটি মেধাবী ছিল। কয়েকদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তখন আমাকে জানায় ও কিছুদিনের মধ্যে বেলিজ যাচ্ছে। ওর এমন মৃত্যু মেনে নেওয়ার মতো না।

শৌলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান খান বলেন, ছেলেটি সফলতার দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিল। আর কিছুদিন পরে ওর পরিবারের আর কষ্ট থাকতো না। এমন মৃত্যু মেনে নেওয়ার মতো না। আমি সব সময় আমার সাধ্যমতো পরিবারটির পাশে থাকার চেষ্টা করবো।

এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।