গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়া
জামালপুরের সরিষাবাড়ীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়া। একসময় শহরে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন সংক্রমণ ছড়িয়েছে গ্রামগঞ্জে। স্থানীয়দের দাবি, এ উপজেলার গ্রামের অধিকাংশ অভিভাবক অশিক্ষিত। কারও কারও অক্ষরজ্ঞানও নেই। এ সুযোগে তাদের সন্তানরা ঘরে বসেই খেলছেন এ খেলা। কোনো কোনো যুবক স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লিপ্ত হচ্ছেন জুয়ায়।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, অনলাইন জুয়া শুরুতে বেশ মজার মনে হলেও আসলে এটি একটি ভয়ংকর ফাঁদ। পুরো ‘গেম-প্ল্যান’ এমনভাবে তৈরি করা হয় যে, জুয়াড়ি দু-একবার জিতবেন, কিন্তু এতে আসক্ত হয়ে খেলা চালিয়ে গেলে সর্বস্ব খোয়াবেন। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে উপজেলার আওনা ইউনিয়নের স্থল পশ্চিমপাড়া এলাকা থেকে সবুজসহ তার এক সহযোগীকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। এরপর থেকেই আলোচনায় আসে এই উপজেলার অনলাইন জুয়ার ভয়াল চিত্র। পরে জামিনে এসে এলাকা ছাড়েন সবুজ। তবে তার দেখানো পথেই হাঁটছেন এলাকার অনেক জুয়াড়ি।
আসক্তরা অধিকাংশই তরুণ। তবে ধীরে ধীরে উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন এবং পৌরসভার সব বয়সী মানুষের মাঝে এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এলাকাবাসীর মধ্যে।
এ বিষয়ে বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হন স্থল গ্রামের রাজু আহমেদ নামে এক যুবক। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, গ্রেফতার সবুজ এসএসসি পাসের পর নাম লিখিয়েছিলেন অনলাইন জুয়ায়। হাতে দামি ঘড়ি, পরনে নিত্যনতুন পোশাক, দামি মোটরসাইকেলের কল্যাণে একসময় নতুনভাবে পরিচিতি লাভ করেন। তার এমন চলাফেরায় আকৃষ্ট হতে থাকেন অভিভাবকসহ এলাকার উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা। পড়ালেখা বাদ দিয়ে মেতে ওঠেন এই খেলায়। পরবর্তী সময়ে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ডিবির জালে বন্দি হন তিনি। কিছুদিন জেলে থাকার পর জামিনে মুক্ত হয়ে এলাকা ছাড়লেও এখন এ এলাকায় রয়েছে তার শক্ত নেটওয়ার্ক।
তিনি আরও জানান, বেশ কিছু জুয়াড়ি বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে আওনা ইউনিয়নে দুর্গম গুইঞ্চারচরসহ বিভিন্ন এলাকায় শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। ওই এলাকা থেকে তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
এছাড়াও পোগলদিঘা ইউনিয়নের চর পোগলদিঘা গ্রামের আসাদ মিলন নামে আরেক যুবক জাগো নিউজকে বলেন, এলাকায় অনলাইন জুয়া একটি শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অপেক্ষাকৃত স্মার্টরা ফ্রিল্যান্সিংয়ের মোড়কে গড়ে তুলেছেন রমরমা জুয়ার ব্যবসা। কেউ স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে লিপ্ত হচ্ছেন এ অনৈতিক কাজে। এমনকি স্কুল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা এজেন্টশিপের মাধ্যমে খেলছেন সমাজ ধ্বংসের এ অস্থির খেলা।
তিনি আরও জানান, একসময় এটি শহরে সীমাবদ্ধ থাকলেও তার এলাকাসহ আশপাশের এলাকা এখন জুয়াড়িদের অভয়ারণ্য। এতে একদিকে যেমন বাড়ছে পারিবারিক কলহ, অন্যদিকে তৈরি হচ্ছে কিশোরগ্যাংয়ের মতো ভয়াবহ কালচার।
জুয়ার প্রভাবে খুন
অনলাইন জুয়ার প্রভাবে গত দুই বছরে এ উপজেলায় একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দু-একজনকে গ্রেফতার করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন মাস্টারমাইন্ডরা। ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট সন্ধ্যায় সরিষাবাড়ী পৌরসভার বলারদিয়ার গ্রামের মানসিক প্রতিবন্ধী আশরাফ হোসেনের ছেলে রিফাত (১৭) ও একই এলাকার সুলতান মাহমুদের ছেলে রাহাত মিয়া (২০) বলারদিয়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায় মোবাইলে জুয়া খেলার একপর্যায়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাতে রিফাতের বাড়ি গিয়ে তাকে মারপিট করেন রাহাত। পরদিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পথে রিফাতের মৃত্যু হয়।
এ বিষয়ে রিফাতের দাদা রসুল মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী। চাকুরির সুবাদে রিফাতের মা ঢাকায় থাকেন। এ অবস্থায় আমি একা। মামলা চালানোর সামর্থ্যও আমার নাই। তাই মামলাটি কী পর্যায়ে রয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে নাতির স্মৃতি এখনো বয়ে বেড়াই। আমি আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করছি।
চলতি বছরের ২৭ মার্চ উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের চর বালিয়া গ্রামের উশর আলীর ছেলে উজ্জ্বল সন্ধ্যায় মোবাইলে ফোন পেয়ে বাড়ির বাইরে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। পরদিন থানায় অভিযোগ করেন তার বাবা। ৫ দিন পর, প্রতিবেশী আপেল মিয়ার পরিত্যক্ত টয়লেটের সেপটিক ট্যাংক থেকে উজ্জ্বলের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। স্থানীয়দের দাবি, অনলাইন জুয়াকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
উজ্জ্বলের ফুপাতো ভাই মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, অনলাইন জুয়াকে কেন্দ্র করে মূলত তার ভাইকে খুন করা হয়। এ ঘটনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হওয়ায় পুলিশ চারজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হওয়া আসামিরা দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় মদ, জুয়া থেকে শুরু করে নানা অপকর্ম করতেন। তারা গ্রেফতার হওয়ায় এলাকায় শান্তি বিরাজ করছে। তবে তাদের পরিবারকে প্রতিনিয়ত মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি-ধমকি করা হচ্ছে।
এ দুটি ঘটনার মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে সরিষাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুশফিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ৬ মাস আগে এ থানায় যোগদান করি। তাই প্রথম ঘটনাটি সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। যেহেতু ২০২২ সালের ঘটনা, এটি মনে হয় বিচারাধীন। দ্বিতীয় ঘটনাটিতে এখনো ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসেনি। রিপোর্ট এলে চার্জশিট দাখিল করা হবে। তবে এ মামলায় সব আসামিকে গ্রেফতার রয়েছে।
উপজেলায় অনলাইন জুয়ার বিস্তার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সঠিক তথ্য প্রমাণ না থাকায় কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন না তারা। তবে বিট পুলিশিং-এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সব সময় সচেতন করার চেষ্টা করছেন।
অনলাইন জুয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে কবি ও প্রাবন্ধিক জাকারিয়া জাহাঙ্গীর জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের দেশে অনলাইনে শিশুদের উপস্থিতি যতটা সহজ ও ঝুঁকিপূর্ণ, পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে হয়তো ততটা নয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেখানে তরুণদের তথ্যপ্রযুক্তিতে যোগ্য করে গড়ে তুলতে অনলাইনকে ব্যবহার করা হচ্ছে, আমরা এর বিপরীত। ফেসবুক-ইউটিউবকে ব্যবহার করা হয় খারাপভাবে। শিশুরা অবাধে অনলাইন গেম ও কার্টুনের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ছে। ইদানিং অনলাইনে লোভনীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করে সুকৌশলে বিভিন্ন জুয়ার দিকে ধাবিত করছে সংঘবদ্ধ ও অনলাইন কর্পোরেট চক্র। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা।
জামালপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সোহেল মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, অনলাইন জুয়া এমন একটি খেলা যেটি ঘরে বসেই জুয়াড়িরা খেলতে পারেন। সচরাচর ৮-১০ জন মিলে ঘরের মধ্যে যে খেলাটা খেলে, যার কারণে সমাজে নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট পড়ে সেটা প্রতিরোধ করা গেলেও অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে সেভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা ছাড়া কোনোভাবেই এটি রোধ করা সম্ভব নয়। আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ থাকলে সব সময় ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করে থাকি। নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে অবশ্যই আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
মো. নাসিম উদ্দিন/এমএইচআর/জেআইএম