শিকলে বাঁধা লাচ্ছি বালা ত্রিপুরার জীবন
স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে প্রায় ১৫ বছর আগে। ষাটোর্ধ্ব বিধবা মা আর তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে লাচ্ছি বালা ত্রিপুরার সংসার। মা আর ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতেই আশ্রিত ছিলেন এই নারী। অন্যের জমিতে কাজ করেই চলতো তার সংসার। লাচ্ছি বালা ত্রিপুরা পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলাধীন মাটিরাঙ্গা সদর ইউনিয়নের দুর্গম ধন্তীরামপাড়ার বাসিন্দা।
কয়েক বছর আগে ভাই তাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে ধন্তীরামপাড়ার পৈত্রিক জমিতে একটি ফুটো টিনের চালা দিয়ে ঝুপড়ি ঘরে বৃদ্ধ মা আর তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন লাচ্ছি বালা ত্রিপুরা। কিন্তু বাসস্থান হারিয়ে লাচ্ছি বালা ত্রিপুরা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। কথা বলেন এলোমেলো। মা আড়াল হলেই দূরে কোথাও চলে যান। তাই বাধ্য হয়েই মেয়েকে শিকলে বেঁধে রেখেছেন ষাটোর্ধ্ব মা হৈমন্তী ত্রিপুরা। এভাবেই গত চার মাসের বেশি সময় ধরে শিকলে বাঁধা জীবন কাটছে লাচ্ছি বালা ত্রিপুরার।
বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সোমবার (১৫ জুলাই) দুপুরের দিকে ধন্তীরামপাড়ার ওই মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর ঝুপড়ি ঘরে ছুটে যান মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ডেজী চক্রবর্তী।
এ সময় মাটিরাঙ্গা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. ইশতিয়াক আহম্মেদ, মাটিরাঙ্গা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হেমেন্দ্র ত্রিপুরা ও উপসহকারী প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন উপস্থিত ছিলেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ফুটো টিনের ঝুপড়ি ঘরের খুঁটির সঙ্গে হাতে শিকল ও তালা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে মানসিক ভারসাম্যহীন লাচ্ছি বালা ত্রিপুরাকে। পাশেই তার নাবালক তিন সন্তানকে নিয়ে বসে আছেন বৃদ্ধা মা হৈমন্তী। মায়ের চোখে-মুখে-কপালে চিন্তার ভাঁজ। বন্দি জীবন থেকে মুক্তির জন্য শিকল ধরে টানাটানি করছেন লাচ্ছি। মাঝে মাঝেই নিজের রাগ-ক্ষোভ ঝাড়ছেন মায়ের ওপর।
ভাঙা ভাঙা বাংলা ও ত্রিপুরা ভাষায় মেয়ের চিকিৎসা আর নাতি-নাতনিদের শিক্ষাসহ ভরণ-পোষণ নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়ে বৃদ্ধ হৈমন্তী ত্রিপুরা বলেন, নিজেদের জমি নেই। বৃষ্টির সময় বসবাস করা কঠিন হলেও নাতি-নাতনিদের আগলে রাখেন। ঠিকমতো খাবার জোটে না। প্রতিবেশীরা দিলে খাওয়া হয়। নইলে উপোস থাকেন।
জানতে চাইলে বলেন, যেখানে মাথা গোঁজার ঠাই নেই সেখানে মেয়ের চিকিৎসা কীভাবে করবো।
প্রতিবেশী বিক্রম ত্রিপুরা বলেন, তাদের সংসারে খুব অভাব। লাচ্ছি বালা ত্রিপুরার চিকিৎসাসহ পরিবারটির পুনর্বাসনের দাবি জানান তিনি।
আরেক প্রতিবেশী প্রমিলা ত্রিপুরা বলেন, কয়েকমাস আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন থেকে তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। এখন তাদের ভরণ-পোষণসহ মানসিক ভারসাম্যহীন লাচ্ছি বালা ত্রিপুরার চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবি জানান সরকারের কাছে।
মাটিরাঙ্গা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হেমেন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, লাচ্ছি বালা ত্রিপুরা চিকিৎসার অভাবে শিকলে বাঁধা থাকেন, তা তিনি জানতেন না। বিষয়টি জেনেই তাদের খবর নিতে ছুটে এসেছেন। লাচ্ছি বালা ত্রিপুরার চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ তাদের পুনর্বাসনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে উদ্যোগ নেবেন বলে জানান।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ডেজী চক্রবর্তী বলেন, বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জানার পর আমরা সরেজমিনে দেখলাম। আপাতত ওই পরিবারের থাকার ঘর মেরামতের জন্য দুই বান্ডিল ঢেউটিন, খাদ্য ও নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হলো। তার চিকিৎসায় ও সন্তানদের লেখাপড়া নিশ্চিত করতে সমাজসেবা অফিসারকে বলেছি। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ওই পরিবারটির পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
মুজিবুর রহমান ভুইয়া/এফএ/জেআইএম