ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা হয়েই কোটিপতি!
ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. জেহাদুল ইসলাম সরকার (৪৮)। তৃতীয় শ্রেণির এই চাকরির ১১তম গ্রেডের সর্বোচ্চ বেতন ৩২ হাজার ২৪০ টাকা। এই বেতনে চাকরি করেই কোটিপতি তিনি। বাস করেন ছয়তলা ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ফ্ল্যাটে।
এ ভূমি কর্মকর্তা বর্তমানে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ঘুড়কা ইউনিয়নে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি একই উপজেলার তিন নান্দিনা গ্রামের কৃষক মৃত আব্দুস সামাদ সরকারের ছেলে।
জানা গেছে, জেহাদুল ইসলাম সরকার ১৯৭৫ সালের ২১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ১৯৯৬ সালে ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী পদে যোগ দেন। পরে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপরই কপাল খুলে যায় এ কর্মকর্তার। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে জমি খারিজ, খাজনা, নামজারি ও পর্চার কাজে ঘুস নিয়ে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। ইতোমধ্যে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রে বাসস্থানের ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন। শুধু তাই নয়, বিদেশ যেতে ২০২৩ সালের ১১ মে স্ত্রী শারমিন সুলতানা, একমাত্র সন্তান রাতুল হাসান ও নিজের নামে পাসপোর্ট করতে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে বিভাগীয় অনাপত্তি সনদ (এনওসি) নেন।
‘জমির নামজারিসহ ভূমি সংক্রান্ত কোনো কাজ করতে গেলেই জেহাদুল ইসলাম সরকারকে ঘুস দিতে হয়। ঘুস ও দুর্নীতির অভিযোগে তিনি আগের কয়েকটি কর্মস্থলে বদলিও হয়েছিলেন। এত অনিয়ম-দুর্নীতির শাস্তি কি শুধুই বদলি?’- আব্দুর রাজ্জাক, ভুক্তভোগী
ভূমি সহকারী কর্মকর্তার যত সম্পদ
সরেজমিনে ও তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, জেহাদুল ইসলাম সরকার ২০১৭ সালে সিরাজগঞ্জ পৌর শহরের সয়াধানগড়া দক্ষিণ মহল্লায় জায়গা কেনেন। পরে ২০১৯ সালে সেখানে গড়ে তোলেন ছয়তলা বাড়ি। বাড়ি নির্মাণের কথা বলে বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন সিরাজগঞ্জ শাখা থেকে ১৫ লাখ টাকা ঋণ নেন। বাড়িটির প্রতিটি তলার আয়তন আড়াই হাজার বর্গফুট। ওই বছরই একই এলাকার খানপাড়ায় কেনেন দুটি টিনশেড বাড়ি।
আরও পড়ুন
- নজরদারির অভাবে প্রশাসনে লাগাম ছাড়াচ্ছে দুর্নীতি
- সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব: নতুন নাকি প্রচলিত আইনের প্রয়োগ?
- দুর্নীতিবাজের ইবাদত কি কবুল হয়?
এছাড়া রায়গঞ্জ উপজেলার তিন নান্দিনা মৌজায় রয়েছে অন্তত ৬ বিঘা ফসলি। এই জমি বর্গা দিয়েছেন বলে জেহাদুলের এক স্বজন জানিয়েছেন।
‘জেহাদুল ইসলাম ছাড়াও কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা এ মহল্লায় বসবাস করেন। তারা একেকজন দোতলা বাড়ির কাজ পাঁচ বছরেও শেষ করতে পারেননি। আর জেহাদুল ইসলাম মাত্র কয়েক মাসেই ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। একই সঙ্গে খানপাড়ায় তিন কোটি টাকার দুটি বাড়িও কিনেছেন।’ -শাকিল আহম্মেদ, প্রতিবেশী
ছাড়তে পারেননি ঘুস নেওয়া
জেহাদুল ইসলাম সরকারের আঙুল ফুলে কলা গাছ হওয়ায় বিস্মিত আত্মীয়স্বজন ও স্থানীয়রা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার এক স্বজন জাগো নিউজকে বলেন, জেহাদুল ইসলাম সরকার ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা হয়েই ঘুস লেনদেনে জড়িয়ে পড়েন। এসব কারণে অল্প সময়ে কয়েকবার বদলিও হয়েছেন। কিন্তু ঘুস নেওয়ার অভ্যাস আজও ছাড়তে পাড়েননি।
‘অনিয়ম ও-দুর্নীতি ছাড়া একজন সরকারি কর্মচারীর এত সম্পদ অর্জন সম্ভব নয়।’-কাজী সোহেল রানা, সদস্য, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, সিরাজগঞ্জ
ঘুড়কা ইউনিয়নের লাঙ্গনমোড়া গ্রামের ভুক্তভোগী আব্দুর রাজ্জাক জাগো নিউজকে বলেন, ‘জমির নামজারিসহ ভূমি সংক্রান্ত কোনো কাজ করতে গেলেই জেহাদুল ইসলাম সরকারকে ঘুস দিতে হয়। ঘুস ও দুর্নীতির অভিযোগে তিনি আগের কয়েকটি কর্মস্থলে বদলিও হয়েছিলেন। এত অনিয়ম-দুর্নীতির শাস্তি কি শুধুই বদলি?’
আরও পড়ুন
- গুনে গুনে ঘুস নেন জনস্বাস্থ্যের মাঠ কর্মকর্তা শাহদাত
- অবৈধ সম্পদ গড়ে কারাগারে পিয়নের ৩ স্ত্রী, স্বামী খালাস
- আজিমপুর মাতৃসদনে কেনাকাটায় অনিয়ম: চার্জশিট দাখিল
সিরাজগঞ্জ পৌর শহরের সয়াধানগড়া দক্ষিণ মহল্লার শাকিল আহম্মেদ নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেহাদুল ইসলাম ছাড়াও কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা এ মহল্লায় বসবাস করেন। তারা একেকজন দোতলা বাড়ির কাজ পাঁচ বছরেও শেষ করতে পারেননি। আর জেহাদুল ইসলাম মাত্র কয়েক মাসেই ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। একই সঙ্গে খানপাড়ায় তিন কোটি টাকায় জমিসহ দুটি বাড়িও কিনেছেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেহাদুল ইসলামের এক প্রতিবেশী জাগো নিউজকে জানান, এ ভূমি কর্মকর্তার উল্লাপাড়ায় একটি বাড়ি রয়েছে। ওই উপজেলায় দায়িত্ব পালনকালে সেটি কিনেছিলেন বলে তিনি জানান।
যা বললেন জেহাদুল ইসলাম সরকার
সম্পদের বিষয়ে ঘুড়কা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা জেহাদুল ইসলাম সরকার জাগো নিউজকে বলেন, হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকে ঋণ ও বেতনের টাকায় সয়াধানগড়া দক্ষিণে ছয়তলা বাড়ি করেছি।
আরও পড়ুন
- সাবেক ভূমিমন্ত্রীর অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের রিট তালিকা থেকে বাদ
- আমরা সৎ থাকলে দুর্নীতি হওয়ার সুযোগ কম: কাদের
- পাসপোর্ট অধিদপ্তরের গাড়িচালকের পাঁচতলা বাড়ি জব্দ
খানপাড়ায় আপনার টিনশেড বাড়ি আছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলেন। এরপর অফিসের কাজে তিনি ব্যস্ত বলে ফোন কেটে দেন।
‘লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’- ইমরান হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)
ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ বাবদ সিরাজগঞ্জ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকে এ ভূমি কর্মকর্তা কত টাকা ঋণ নিয়েছেন সেটি জানতে গত ৮ জুলাই সেখানে যান এই প্রতিবেদক। শাখা ব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ জাগো নিউজকে জানান, জেহাদুল ইসলাম ২০১৯ সালে শহরের সয়াধানগড়া দক্ষিণের বাড়িটি এ শাখায় দায়বদ্ধ রেখে ১৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন, যা এখন পরিশোধের শেষ পর্যায়ে।
আরও পড়ুন
- চট্টগ্রামে স্ত্রীসহ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা
- বান্দরবানে বেনজীরের সম্পত্তি তত্ত্বাবধানে নিলো প্রশাসন
- প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ তদন্তে পিএসসির ৩ সদস্যের কমিটি
- সাব রেজিস্ট্রারের মাসে গাড়িভাড়া ৭০ হাজার, বাড়িভাড়া ১৮!
দুদককে খতিয়ে দেখার অনুরোধ
এদিকে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তার অঢেল সম্পদের বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য কাজী সোহেল রানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনিয়ম ও-দুর্নীতি ছাড়া একজন সরকারি কর্মচারীর এত সম্পদ অর্জন সম্ভব নয়।’ তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বিষয়টি খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানান।
জেহাদুল ইসলাম সরকারের বিষয়ে সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ইমরান হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তসাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এমএএম/এমএমএআর/এমএস