ফরিদপুর
পেঁয়াজ সংরক্ষণে ৬৫ মডেল ঘর নির্মাণ, কৃষকের মুখে হাসি
পেঁয়াজ উৎপাদনের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ফরিদপুর জেলা। আর জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় সালথা ও নগরকান্দা উপজেলায়। মসলা জাতীয় এ ফসলটির ফলন ও দাম ভালো হওয়ায় প্রতিবছরই বাড়ছে পেঁয়াজের চাষ। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে এখানকার উৎপাদিত পেঁয়াজের ২৫-৩০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেঁয়াজ সংরক্ষণে সালথা ও নগরকান্দা উপজেলায় ৬৫টি মডেল ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এরই মধ্যে এসব ঘরে পেঁয়াজ মজুত রেখে কৃষকদের মুখে হাঁসি ফুটতে শুরু করেছে।
কৃষকদের দাবি, পেঁয়াজ চাষিদের তালিকা করে এমন ঘর প্রত্যেকটি গ্রামে নির্মাণ করা হলে তারা উপকৃত হবেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার ঝুনাখালি গ্রামের কৃষক মো. আমজেদ মাতুব্বরের বাড়ির উঠানে এক শতক জমির ওপর চার লাখ টাকা ব্যয়ে টিনের চাল ও বাঁশের বেড়া দিয়ে একটি মডেল ঘর নির্মাণ করা হয়। ১৫টি পাকা খাম্বার ওপর ২৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট প্রস্থ ঘরটি তৈরি হয়েছে।
মাটি থেকে তিন ফুট পরপর তিনটি বাঁশের মাচা বানানো হয়েছে। ওই মাচার ওপরে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে পেঁয়াজ। ঘরের নিচে আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ঘরের গরম বাতাস বের করার জন্য পেছনে দেওয়া হয়েছে ছয়টি ফ্যান। ঝড়-বৃষ্টি থেকে পেঁয়াজ রক্ষা করতে চারপাশে রাখা হয়েছে ত্রিপল। ওই ঘরে ৩০০ মন করে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যাবে। সেখানে ৬-৯ মাস পেঁয়াজ ভালো থাকবে।
কৃষক আমজেদ মাতুব্বর বলেন, গত বছর আমার বাড়ির ঘরটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর ১৪০ মণ পেঁয়াজ রেখেছিলাম। যা শুকিয়ে ১৩৫ মণ ভালো ছিল। এবারও এই ঘরে পেঁয়াজ রেখেছি। আমার পাশাপাশি প্রতিবেশী সোহেল হোসেন ৫০ মণ ও শিউলি বেগম ৫০ মণ পেঁয়াজ রেখেছেন।
আড়ুয়াকান্দী গ্রামের কৃষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিবছর কমপক্ষে ৫০০ মণের মতো পেঁয়াজ পাই। পেঁয়াজ পচনশীল। যার কারণে কৃষকদের পক্ষে এটি সংরক্ষণ করা কষ্টসাধ্য। সংরক্ষণের অভাবে অনেক কৃষক পেঁয়াজ মৌসুমে অল্প দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। তবে মডেল ঘর পাওয়ার পর কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়েছি। যদিও এবারই প্রথম মডেল ঘরে পেঁয়াজ রাখা শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত পেঁয়াজ ভালো আছে। মডেল ঘরে ভালোই সফলতা মিলবে।
বোয়ালমারী উপজেলার দাদপুর গ্রামের কৃষক জাকির হোসেন বলেন, বোয়ালমারী উপজেলায়ও পেঁয়াজের আবাদ হয়। তবে এসব উপজেলায় এখন পর্যন্ত কোনো মডেল ঘর নির্মাণ হয়নি। সালথা ও নগরকান্দার মতো আমাদের উপজেলায় পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য মডেল ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হোক।
কৃষিবিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ফরিদপুর জেলায় ৩৫ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল চার লাখ ৪৫ হাজার ৯৮২ টন। গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পেঁয়াজের আবাদ পাঁচ হাজার হেক্টর বেড়ে ৪০ হাজার ৪৩৩ হেক্টর জমিতে হয়েছে। যাতে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে পাঁচ লাখ ৫২ হাজার ৭৩৬ মেট্রিক টন।
এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর থেকে সালথা ও নগরকান্দা উপজেলায় ৬৫টি পেঁয়াজ সংরক্ষণের ঘর নির্মাণ হয়েছে। এরমধ্যে সালথায় ৩০টি ও নগরকান্দায় ৩৫টি। প্রতিটি ঘরে ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে চার লাখ টাকা। ইতিমধ্যে ৬২টি ঘরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাকি তিনটি ঘর নির্মাণ কাজ দেরিতে শেষ হওয়ায়, সেগুলোতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। এসব ঘরে মার্চ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকরা। দুই-তিন বছর পর পর মেরামত করা হলে ঘরটি ২০-২৫ বছর ব্যবহার করা যাবে। একটি ঘরে ৩০০ মন পেঁয়াজ রাখা যাবে। পাঁচজন কৃষকের জন্য একটি ঘর করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. সাহাদাত হোসেন বলেন, দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৮ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হচ্ছে ৩৫ লাখ টন। উৎপাদিত পেঁয়াজের মধ্যে প্রায় ৩০ ভাগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের মধ্যে শেষ পর্যন্ত প্রায় ২২ লাখ টন টিকে থাকে। চাহিদার থেকে বেশি উৎপাদন হওয়ার পরও দেশে প্রতিবছর কমপক্ষে সাত লাখ টন পেঁয়াজ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের তৈরি ঘর দেখে কৃষকরা যদি নিজেদের উদ্যোগে এই মডেল ঘর নির্মাণ করে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করেন, তাহলে তাদের পেঁয়াজ আর নষ্ট হবে না।
এ বিষয়ে ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ফরিদপুরে প্রথম পর্যায়ে ৬৫টি পেঁয়াজ সংরক্ষণের মডেল ঘর নির্মাণ হয়েছে। মডেল ঘর নির্মাণে সফলতার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আরও ঘর নির্মাণ হবে। আমাদের উদ্দেশ্য, এই ঘর দেখে চাষিরা যেন নিজেরা ঘর নির্মাণ করে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করেন। তাহলে তাদের পেঁয়াজ আর নষ্ট হবে না।
এন কে বি নয়ন/জেডএইচ/জিকেএস