সারাবছর গরু পুষে লাভ শূন্য, হতাশ খামারিরা
কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর গরু লালন-পালন করেন পাবনার ঈশ্বরদীর প্রান্তিক খামারিরা। আশা থাকে ঈদে এসব গরু বিক্রি করে একটু লাভের মুখ দেখবেন। ব্যতিক্রম ছিল না এ বছরও। তবে এবার খামারিদের মুখে হাসি ফোটেনি। ন্যায্য দামে গরু বিক্রি করতে না পেরে হতাশ হয়েছেন তারা।
খামারিরা জানান, গো-খাদ্যের দাম আগের তুলনায় বেড়েছে। এরপরও প্রতিবছরের মতো এবারও কোরবানির জন্য গরু-ছাগল লালন-পালন করেন তারা। ধারণা ছিল, খো-খাদ্যের দাম যেমন বেশি, বাজারদরও বেশি হবে। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। সারাবছর লালন-পালন করে কোরবানির ঈদের আগে গরু বিক্রি করে কোনোমতে মূলধন ফেরত পেয়েছেন। অনেকে লোকসান গুনেছেন। আবার অনেকের গরু অবিক্রিত রয়ে গেছে।
খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য এক বছর আগে থেকেই গরু কেনা হয়। একটি গরু যদি এক লাখ ৫০ হাজার টাকায় কেনা হয়, তাহলে সারাবছর ওই গরু পালন করতে এক লাখ ২০ হাজার থেকে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। এরমধ্যে খাদ্যে ব্যয় হয় এক লাখ ১০ হাজার টাকার মতো। শ্রমিক খরচ গড়ে সাড়ে সাত হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিল দুই হাজার টাকা, ওষুধ ৫-৬ হাজার টাকা। সারাবছর পালনের পর গরু কেনা মূল্য ও সারাবছরের খরচসহ ওই গরুর পেছনে খামারির বিনিয়োগ হয় দুই লাখ ৮০ থেকে দুই লাখ ৯০ হাজার টাকা। তখন খামারিরা ওই গরু তিন লাখ ১০ থেকে তিন লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রির আশা করেন।
আরও পড়ুন:
১৫ লাখ টাকার সেই ছাগল দৈনিক খায় দুই কেজি আপেল
গরুপ্রতি তারা ২০-২৫ হাজার টাকা লাভের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু এবছর লাভতো দূরের কথা, অনেকে গরু বিক্রি করে খরচের টাকায় উঠেনি। এতে অনেক প্রান্তিক খামারি হতাশ হয়েছেন। অনেকেই রাগে-ক্ষোভে কোরবানির গরু পালন না করার ঘোষণা দিয়েছেন।
ঈশ্বরদী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এবছর উপজেলার তিন হাজার ৩৬টি খামারে কোরবানির জন্য গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়াসহ ৭২ হাজার পশু প্রস্তুত করা হয়। স্থানীয়ভাবে চাহিদা ছিল ৪১ হাজার পশুর। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৩৩ হাজার কোরবানির পশু অন্যত্র বিক্রির জন্য প্রস্তুত রাখা হয়।
উপজেলার অরণকোলার তানভীর ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী গোলাম কিবরিয়া সোহান। এবছর কোরবানির জন্য ৩০০ গরু প্রস্তুত করেন। তিনি বলেন, ‘৩০০ গরুর মধ্যে বেশিরভাগ এক লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার কিনেছিলাম। আশা করেছিলাম, সব খরচ বাদে গরুপ্রতি ২০-৩০ হাজার টাকা লাভ হবে। কিন্তু তা হয়নি। ৩০০ গরু লালন-পালন করেও লাভবান হতে পারিনি। সব হিসাব-নিকাশ শেষে দেখা গেছে, বছরজুড়ে যে টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল, সে টাকা কোনোমতে উঠেছে।’
হতাশার সুরে তিনি বলেন, ‘কোটি কোটি বিনিয়োগ করে ও সারাবছর পরিশ্রম করেও যদি লাভবান হতে না পারা যায়, তাহলে একসময় হয়তো খামারিরা গরু-লালন পালন ছেড়ে দিবেন।’
উপজেলা দাশুড়িয়া এলাকার খামারি আব্দুল হালিম বলেন, ‘আমার খামারে কোরবানির জন্য ১৫টি গরু লালন-পালন করেছিলাম। একবছর লালন-পালন শেষে কোরবানির হাটে গরু তুলে বুঝতে পেরেছিলাম এবার লোকসান গুনতে হবে। ১৫টির মধ্যে ১৩টি গরু বিক্রি করেছি। এতে লোকসান না হলেও মোটেও লাভ হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘খামারের পেছনে সারাবছর যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি, এ পরিশ্রম অন্য কাজে করলে বছরে দুই চার লাখ টাকা লাভ হতো। এবার গরু বিক্রি করে লাভ না হওয়ায় আমার মতো অনেকেই হতাশ হয়েছেন।’
আরও পড়ুন
অরণকোলা এলাকার জেবা পোলট্রি ও ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী জমির উদ্দিন আহমেদ জিন্নাহ বলেন, ‘আমার খামারে এবার ১০০ দেশি ছোট গরু লালন-পালন করেছিলাম। এসব গরু ৮০-৯০ হাজার টাকায় কেনা ছিল। একবছর পালন-পালন শেষে কোরবানির সময় এক লাখ ১০ থেকে এক লাখ ১৫ হাজার টাকায় বিক্রির আশা ছিল। ভেবেছিলাম গরুপ্রতি ১০-১৫ হাজার টাকা লাভ হবে। কিন্তু এবার তা হয়নি। কিছু গরু অবিক্রিত রয়ে গেছে। আমার মতো অনেক খামারি এবার গরু বিক্রি করতে পারেননি। এতে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’
উপজেলার মানিকনগর গ্রামের আহাদ আলী নিজের খামারের ১৮টি গরু নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন। এরমধ্যে ১৩টি বিক্রি হলেও পাঁচটি গরু ফেরত আনতে হয়েছে। ১৩ গরু বিক্রি করেও লাভের মুখ দেখতে পাননি।
আহাদ আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকায় ঈদের এক সপ্তাহ আগে গরু নিয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ভালো দামে গরু বিক্রি হবে। কিন্তু সারাবছরে গরুর পেছনে যে খরচ, কোটি টাকা বিনিয়োগ, এনজিওর ঋণের কিস্তি ও পরিশ্রম—সবকিছুর হিসাব মিলিয়ে দেখলাম গরুপ্রতি ১০-১৫ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে।’
পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. গৌরাংগ কুমার তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, কোরবানির গরু বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এমন অভিযোগ আমাদের কাছে কেউ করেননি। ঈদের আগে গরুর হাটে গেলে প্রায়ই দেখা যায় খামারি ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, গরুর ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। আবার ক্রেতা বা ভোক্তারা বলছেন, এবার গরুর দাম বেশি। প্রতিবছরই কোরবানির কিছু গরু অবিক্রিত থাকে। এবারও হয়তো আছে।
তিনি বলেন, কোরবানির গরু বিক্রি করে অনেক খামারি লাভবান হয়েছেন। পাশাপাশি অনেকের লোকসানও হতে পারে। বেচাকেনার বিষয়টি সময়, স্থান ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।
এসআর/এএইচ/এমএস