সাপের কামড়ে মৃত্যু
কড়ি দিয়ে জীবিত করতে চাওয়া কবিরাজ টাকা নিয়ে উধাও, মাঝরাতে দাফন
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সাপের কামড়ে মৃত এক যুবককে ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে জীবিত করার আয়োজন করেন এক ভুয়া কবিরাজ। পরে কড়ি (ছোট শামুকের খোল যা ওঝা কবিরাজরা ঝাড়ফুঁকে ব্যবহার করে থাকেন) আনার কথা বলে ১৫ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। অবশেষে নানা আয়োজন করে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর মধ্যরাতে দাফন সম্পন্ন করা হয়।
মৃত সাইফুল ইসলাম (৪০) গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বাসুরা গ্রামের ইউনুছ আলীর ছেলে। সাইফুল ইসলাম পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি ছিলেন। শনিবার (২৯ জুন) দিবাগত মধ্যরাতে তার দফন সম্পন্ন হয়।
এলাকাবাসী ও নিহতের স্বজনরা জানান, সাইফুল শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে হাতে টেঁটা নিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে মাছ ধরতে বাড়ির পাশের একটি বিলে যান। মাছ ধরতে যাওয়ার পথে হঠাৎ সাইফুলের বাম পায়ে বিষধর একটি সাপ কামড় দেয়। এরপর সঙ্গে থাকা অন্য ব্যক্তি টেঁটা দিয়ে সাপটি মেরে ফেলেন। পরে মৃত সাপটি নিয়ে সাইফুল বাড়িতে ফিরে স্বজন ও এলাকাবাসীকে ঘটনাটি জানান। পরে স্বজনরা তাকে কবিরাজের কাছে নিয়ে যান।
ঝাড়ফুঁক শেষে কবিরাজের বাড়ি থেকে রাতেই তাকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার সকালে তার মৃত্যু হয়। হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে মরদেহ বাড়িতেও নিয়ে আসেন স্বজনরা। দুপুর দুইটাই জানাজার সময় নির্ধারণ করা হয়। এমনকি দাফনের জন্য কাফনের কাপড়ও পরানো হয়।
এমন সময় এক কবিরাজ তাদের বাড়িতে আসেন। পরে তিনি বলেন, ‘এই লাশ এখনো মরেনি। মৃত ব্যক্তিরদের শরীর শক্ত হয়ে যায় কিন্তু তার শরীর শক্ত হয়নি। ঘুমন্ত মানুষের মতো নড়াচড়া করছে। কড়ি নিয়ে এসে ঝাড়ফুঁক করলে তাকে সুস্থ করা সম্ভব।’
কবিরাজের এমন কথার পর মরদেহ দাফন বন্ধ করা হয়। পরে কবিরাজের কথামতো খোলা মাঠের মধ্যে কলা গাছ, দুধ, মহিষের শিংসহ বিভিন্ন আয়োজন করা হয়। কবিরাজের চিকিৎসার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে আশপাশ থেকে শতশত লোক তাদের বাড়িতে ভিড় করতে থাকেন। এমন সময় কবিরাজ তাদের জানায় তার চিকিৎসার জন্য কড়ি প্রয়োজন। এটি সাভারে পাওয়া যেতে পারে, এর জন্য কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা লাগবে। কবিরাজের কথা মতো তাকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে পাঠানো হয় সাভারে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতে থাকে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত বারোটা বেজে গেলেও সেই কবিরাজ আর ফিরে আসেনি।
শনিবার সন্ধ্যায় বাসুরা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মৃত সাইফুলকে জীবিত করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন কবিরাজ। বাড়ির পাশে একটি ক্ষেতে চারটি কলাগাছ পুঁতে রাখা হয়েছে, চারপাশে ঘেরাও করে কয়েকটি সিলভারের নতুন কলস বসানো হয়েছে। কলাগাছের চার কোণায় চারটি গ্লাসে দুধ ও একটা মহিষের শিং রাখা হয়েছে। রাতের আঁধার দূর করতে একাধিক বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। পুঁতে রাখা চারটি কলাগাছের মাঝে টেবিলের ওপর মৃত সাইফুলের মরদেহ রাখা। পাশে রাখা হয়েছে মৃত সাপটি। এভাবেই কবিরাজ তাকে জীবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। খবর পেয়ে বাসুরা পশ্চিমপাড়া বাইতুন নুর জামে মসজিদ এলাকার আশপাশে কয়েকটি গ্রামের মানুষ সেখানে ভিড় করেন।
স্থানীয় মসজিদের ইমাম আবদুল জলিল বলেন, মৃত ব্যক্তিকে আবারো দাফন কাফন পরানো হয় এবং শেষরাতে তার জানাজা শেষে দাফন করা হয়েছে।
নিহত সাইফুলের সহকর্মী টাইলস মিস্ত্রি জাকির হোসেন বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণার পর সাইফুলকে অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামে আনা হয়। এক কবিরাজ মরদেহ দেখে বলেন, ‘এটা ডেড বডি হয় নাই। আমরা কড়ি চালান দেব। রাত ৮টা থেকে ১২টার মধ্যে কড়ি চালান দিয়ে তাকে সুস্থ করা সম্ভব।’
তবে ঘটনাস্থলে ওই কবিরাজকে পাওয়া যায়নি। ঝাড়ফুঁক দেওয়ার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে তিনি সাভারে গিয়েছেন বলে স্থানীয় লোকজন জানান।
উপজেলার বেনুপুর এলাকার আরমান হোসেন বলেন, ‘জানাজা হওয়ার কথা ছিল। কবিরাজ নাকি সাত দিন আগের সাপে কাটা মানুষকেও জীবিত করতে পারেন। এরপর থেকে এই আয়োজন চলে।’
আনোয়ার হোসেন নামের একজন বলেন, ‘এই আধুনিক যুগে এমন কুসংস্কার মেনে নেওয়া যায় না। অবশ্যই এলাকার সচেতন মানুষ ও প্রশাসনের উচিত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।’
নিহতের ভাই আলী হোসেন বলেন, কলাগাছ, দুধ, নতুন সিলভারের কলসিসহ অনেক কিছু ব্যবস্থা করেছি। পরে ওঝা বলে তার চিকিৎসার জন্য কড়ি লাগবে। ভালো কড়ি নাকি পাওয়া যায় সাভারে। কড়ি আনতে গিয়ে সে আর ফিরে আসেনি। পরে গ্রামবাসী ও সবার পরামর্শে রাতে জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন করা হয়।
কালিয়াকৈর উপজেলার ঢালজোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইছামুদ্দিন বলেন, কবিরাজ প্রথমে বলেছে কড়ির জন্য ধামরাই যেতে হবে। ধামরাইয়ে খোঁজাখুঁজি করে সে বলে কড়ি এখানে নেই সাভার যেতে হবে। সাভার গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে সে জানায় এখানেও কড়ি নেই যেতে হবে কুমিল্লা। এরপর আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। সে ফিরে না আসায় রাত দেড়টার দিকে জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করা হয়।
কালিয়াকৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম নাসিম বলেন, ‘সন্ধ্যায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক গিয়েছিলেন কিন্তু নিহতের স্বজনরা তাকে ধরতে দেননি। ওঝা নাকি বলে গেছেন, চিকিৎসা শেষ করার আগ পর্যন্ত এই মরদেহ ধরা যাবে না। কিন্তু ওই ওঝা কড়ি আনার কথা বলে গিয়ে আর ফিরে আসেননি।’
আমিনুল ইসলাম/এফএ/এমএস