রানা প্লাজা ধস : তিন বছরেও সনাক্ত হয়নি নওগাঁর ২১ জন


প্রকাশিত: ০৪:৫৬ এএম, ২৫ এপ্রিল ২০১৬
নিখোঁজ লিপির ফাইল ছবি

রানা প্লাজা ধসের তিন বছর পার হলেও এখনও নওগাঁর ২১ জনের পরিচয় সনাক্ত হয়নি। এ ঘটনায় নিহত হয় ২৩ জন। আর অঙ্গহানি হয় ১ জনের। ঘটনার পর অসনাক্তদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে সনাক্ত করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের খোঁজ মেলেনি। নিহতদেরও মরদেহ ফেরত দেয়া সম্ভব হয়নি।

এদিকে, নিহত হওয়ার পর সরকার থেকে পরিবারের সদস্যদের এক লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত দেয়া হলেও পরে আর কোনো খোঁজ খবর নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করা হয়।

জানা গেছে, নওগাঁ কৃষি প্রধান এলাকা হওয়ায় বছরের ৬/৭ মাস কোনো কাজ থাকে না। এতে নিম্ন আয়ের লোকজনদের পরিবারের সদস্য নিয়ে কষ্টে জীবন-যাপন করতে হয়। পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে নিম্ন আয়ের পরিবারের শত শত বেকার যুবক/যুবতীরা ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করে। এতে যেটুকু টাকা পায় তাতে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনো মতো জীবনযাপন করে। কিন্তু তিন বছর আগে ২৪ এপ্রিল ঢাকার সাভারে রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার কারণে জেলার ৪৫টি পরিবারকে পথে বসতে হয়েছে।

পরিচয় পাওয়া যায়নি যাদের তারা হলেন :

বদলগাছী উপজেলার থুপশহন গ্রামের কবির উদ্দীনের মেয়ে পপি আক্তার, বিশালবাড়ী গ্রামের ওমর আলীর ছেলে ইমরান হোসেন (২৫), মান্দা উপজেলার কাঞ্চন গ্রামের জয়নাল আবেদিনের মেয়ে সুলতানা খাতুন (১৮), বনকুড়া গ্রামের আজিজুর রহমানের মেয়ে আসমা বেগম, চাকমা শেখ গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে নাজিম উদ্দিন, গোসাইপুর গ্রামের রহমানের ছেলে আব্দুস সালাম (৩৩)।

মহাদেবপুর উপজেলার মোজাম্মেল হকের মেয়ে ইয়াসমিন (২১), মাধবপুর গ্রামের ফরিন্দ্র নাথ বসুর ছেলে প্রভাতী চন্দ্র বসু (৫৫), নওগাঁ সদর উপজেলার আইনুদ্দীন শেখের মেয়ে মাহমুদা আক্তার (৩৫), শিকারপুর গ্রামের আলতাব হোসেনের ছেলে আল আমীন (২৪), কালুশহর গ্রামের আবুল কাশেমের মেয়ে ঝর্ণা বেগম (২৩), রাণীনগর উপজেলার বাবদাগাড়ী গ্রামের মোজাম্মেলের ছেলে আব্দুর।

আত্রাই উপজেলার সাহেবগঞ্জ বাজার এলাকার ফয়েজ উদ্দীন আহম্মেদের মেয়ে মুন্নি (২৮), রাণীনগর গ্রামের নিজাম উদ্দীনের মেয়ে বেবী আক্তার (৩০), ইসলামগাঁথী গ্রামের ছানোয়ার হোসেনের মেয়ে সালেহা (২৮), নিয়ামতপুর উপজেলার বালিচাঁদ গ্রামের মৃত সিরাজ উদ্দীনের স্ত্রী ইসমতারা (৪৩), ক্যাপড়া (চাপড়া) গ্রামের কিয়ামত আলীর মেয়ে কহিনুর (৪২), ভাতকুন্ড গ্রামের হযরত আলীর মেয়ে নাসিমা (৩৫), হারপুর গ্রামের শওকত আলীর মেয়ে শিরিনা (২৪), পারমনিক (বাতকুন্ড) গ্রামের নজি প্রামানিকের মেয়ে স্বপ্না বেগম, পত্নীতলা উপজেলার হাড়পুর গ্রামের আব্দুল মান্নানের মেয়ে লিপি আক্তার (২০)।

অঙ্গহানি হয়েছে নিয়ামতপুর গ্রামের তল্লা গ্রামের জোনাব আলীর মেয়ে সায়মা (২৪)।

নিহতরা হলেন- মান্দা উপজেলার তেলিপাড়া গ্রামের মৃত রফাতুল্লাহের স্ত্রী জহুরা বেগম (৪০), দক্ষিণ নুরুল্ল্যাবাদ গ্রামের ফজলুর রহমানের মেয়ে খাদিজা (১৭), বানিস্বর গ্রামের খাদিজা খাতুন (১৭), হান্নানের মেয়ে সাথী বেগম (২০), ইসমাইলের ছেলে সাহেব আলী (২২), হান্নানের জামাই সেলিম হোসেন (২৯), ফেটগ্রামের বেলায়েত আলীর মেয়ে দুলালী (২৫), মীরপুর গ্রামের আবদুস ছোবানের মেয়ে সাবিনা খাতুন (২১), ভরট্রকাঠের ডাঙ্গা গ্রামের মৃত খয়ের আলীর মেয়ে মরিয়ম (২৫), মহাদেবপুর উপজেলার চককন্দপুর গ্রামের রেজাউল ইসলামের স্ত্রী মেরিনা (২৪), ছোট মহেষপুর গ্রামের মৃত নজরুল ইসলামের ছেলে জুলফিকার আলী মাসুদ (৪৫)।

এছাড়া নিয়ামতপুর উপজেলার সেফায়েতপুর গ্রামের মৃত কমর উদ্দিনের ছেলে জামিল (২৮), হাকিমপুর গ্রামের ছইমুদ্দীনের ছেলে রশিদ (৩৫), তল্লা গ্রামের ছাইদুল ইসলামের ছেলে নাইম (১৮), খইবার মন্ডলের স্ত্রী আকলেমা (৩৫) ও মেয়ে রুনা (১৮), পাছড়া গ্রামের হোসেন আলীর ছেলে সেলিম (২২), বালিচাঁদ গ্রামের  ফয়েজ উদ্দীনের ছেলে রেজাউল হক (১৯), বলিচাঁদ গ্রামের ফয়জুদ্দিনের ছেলে রেজাউল হক (১৯), বদলগাছী উপজেলার মহদীপুর গ্রামের মনতাজুল রহমানের মেয়ে নাছরিন আনোয়ারা রুনা (৩৬), পোরশা উপজেলার গরখাই গ্রামের সামসুল হকের মেয়ে সামছুন্নাহার (১৮), রাণীনগর উপজেলার একডালা গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে শফিউল আলম, বড়গুন্দইল গ্রামের মৃত খাতির মন্ডলের মেয়ে মেরিনা আক্তার (২৯), সাপাহার উপজেলার বিদ্যানন্দী গ্রামের রহিম উদ্দীনের মেয়ে কল্পনা (২১)।

ওই ঘটনায় দেয়াল চাপায় নিয়ামতপুর গ্রামের তল্লা গ্রামের সায়মার মেরুদণ্ডের রগ পুরোটায় নষ্ট হয়ে পঙ্গু হয়ে গেছে। এর ফলে তিনি কখনো সোজা হয়ে চলাফেরা করতে পারেন না। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয়।

সায়মা জানান, তার কোমরের নিচে পুরোটাই অবশ হয়ে গেছে। সরকার থেকে কোনো নগদ টাকা দেয়া হয়নি। তবে সরকার থেকে প্রতি মাসে ৭ হাজার টাকা চিকিৎসা বাবদ খরচ দেয়া হয়। প্রতি মাসে এ টাকা তার চিকিৎসা বাবদ খরচ করতেই শেষ হয়ে যায়। তাতে দুই মেয়ে ও স্বামী নিয়ে অসহায় জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
 
নিহত ও অসনাক্তদের পরিবার নগদ ১ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা পাওয়ার কথা স্বীকার করে অভিযোগ করে বলেন, এরপর থেকে তাদের কোনো খোঁজ খবর নেয়া হয়নি।

বদলগাছী উপজেলার থুপশহন গ্রামের অসনাক্ত পপি আক্তরের ভাই রুবেল জানান, ঘটনার পর দ্রুত ঢাকায় যান। লাশ ঘরে তার বোনকে সনাক্ত করতে পারলেও অপর একজন দাবি করে বসেন। এতে পপির মরদেহ না দিয়ে দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। ডিএনএ নমুনার মাধ্যমে  সনাক্ত করা হলেও তিন বছরেও তার বোনের মরদেহ ফেরত দেয়া হয়নি।

নওগাঁ সদর উপজেলার মাহমুদা আক্তারের বাবা আইনুদ্দীন শেখ জানান জানান, ডিএনএ নমুনার মাধ্যমে মরদেহ সনাক্ত করা হলেও তিন বছরেও তার ছেলের মরদেহ ফেরত দেয়া হয়নি।

পত্নীতলা উপজেলার কাঁটাবাড়ি হাড়পুর গ্রামের অসহায় আব্দুল মান্নানের মেয়ে লিপি আক্তার সাভারের রানা প্লাজার নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড এ মান পরিদর্শক হিসেবে ২০১২ সালে যোগদান করেন। হঠাৎ করে ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের খবর পেয়ে লিপির বাবা মেয়ের খোঁজে ঢাকার সাভারে যান। কিস্তু অনেক খোঁজাখুঁজির পর তিনি তার মেয়েকে পাননি। লিপি আক্তার হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় ২১ মে ঢাকার সাভার থানায় সাধারণ ডায়েরি ও প্রশাসনের কাছে আবেদন করে। ডিএনএ পরীক্ষার পরও লিপির কোন সন্ধান মেলেনি বলে তার পরিবার জানান।

আব্দুল মান্নান তার মেয়েকে না পেয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। তারা তাদের মেয়েকে আদৌও ফিরে পাবে কিনা জানেন না।

মহাদেবপুর উপজেলার চককন্দপুর গ্রামের নিহত মেরিনার ছেলে সানোয়ার, নিয়ামতপুর উপজেলার সেফায়েতপুর গ্রামের আকলেমার স্বামী খয়বার মন্ডল জানান, তারা নগদ ১ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা পেলেও আর কোনো সহযোগিতা পাননি তারা। এমনকি কোনো খোঁজ খবর নেয়া হয়নি।

হোসেন আলী জানান, তাদের একটি ছোট্ট কুঁড়ে ঘর ছাড়া ধন সম্পদ কিছুই নেই। পরিবারের একমাত্র অর্থ উপার্জানকারী ছেলে সেলিম মারা যাওয়ায় এখন অর্থে কষ্টে থাকতে হয়।

এ ব্যাপারে জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা ইউনুস আলী জানান, এগুলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে সম্পন্ন করা হয়। সেখান থেকে যে নির্দেশনা আসবে সে অনুয়ায়ী নির্দেশনা সম্পন্ন করা হবে।

আব্বাস আলী/এসএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।