ঘূর্ণিঝড় রিমাল

বিধ্বস্ত নিঝুমদ্বীপের ৩০ হাজার অধিবাসীর মানবেতর জীবন

ইকবাল হোসেন মজনু ইকবাল হোসেন মজনু , নোয়াখালী
প্রকাশিত: ০৮:৪৩ পিএম, ১৪ জুন ২০২৪
ঘূর্ণিঝড় রিমালে ভিটে-বাড়ি সব হারিয়েছেন লুবনা বেগম। ছবি-জাগো নিউজ

ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে নোয়াখালীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায়। বিচ্ছিন্ন নিঝুমদ্বীপের বেশিরভাগ এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। মানবেতর জীবনযাপন করছেন এ ইউনিয়নের ৩০ হাজার অধিবাসী।

গত ১৭ দিনেও সেখানে উপজেলা প্রশাসনের কেউ না যাওয়ায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। যোগাযোগ ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছেন ইউনিয়নের বাসিন্দারা। বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) নিঝুমদ্বীপে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।

ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দিনাজ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রিমালের তাণ্ডবে অর্ধশত বাড়িঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। চার শতাধিক বাড়িঘরের ভিটের মাটি চলে গেছে। ৩৭টি নতুন করা সড়কের প্রায় ১৮০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রধান সড়কের চার স্থানে ভেঙে চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছে।’

ঘূর্ণিঝড় রিমাল/ বিধ্বস্ত নিঝুমদ্বীপের ৩০ হাজার অধিবাসীর মানবেতর জীবন

তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী ঘূর্ণিঝড়ের আগের দিন থেকে খোঁজখবর রাখছেন। উপজেলা পরিষদ থেকে ১০০ প্যাকেট ত্রাণ, ১০ বান্ডিল ঢেউটিন ও দুই লাখ নগদ টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে বিগত ১৭ দিনেও উপজেলা প্রশাসন বা স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কর্মকর্তাকে নিঝুমদ্বীপ আসতে দেখিনি। উপজেলা চেয়ারম্যান আশিক আলীর আশ্বাসে আমি স্বেচ্ছাশ্রমে লোকজন নিয়ে প্রধান সড়কের ভাঙনের চারটি স্থানে মাটি দিয়ে এবং কয়েক স্থানে অস্থায়ী কাঠের সেতু ও সাঁকো দিয়ে চলাচলের ব্যবস্থা করেছি।’

শূন্য ভিটায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন নিঝুমদ্বীপের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবুল কালাম ও লুবনা বেগম দম্পতি। তারা বলেন, ‘পাঁচটি সন্তান নিয়ে আমরা এখন কোথায় যাবো? কীভাবে থাকবো? ঘর নাই, খাবার নাই, পরনের কোনো কাপড় নাই। সব সর্বনাশা রিমাল কেড়ে নিয়েছে।’

লুবনা বেগম বলেন, ‘এখানে আমাদের ঘর ছিল। পাঁচটি ছাগল ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের তীব্র আঘাতে দিশেহারা হয়ে ছোট্ট ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের পরনের কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে কোনোমতে জীবন রক্ষা করেছি। ঘর-দরজা, ছাগল, হাঁড়ি-পাতিল, ঘরের আসবাবপত্র সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের পরে চেয়ারম্যান ৯ কেজি চাল ও নগদ দুই হাজার টাকা দিয়েছে। এ দিয়ে সাতজন মানুষ চলি কীভাবে?’

ঘূর্ণিঝড় রিমাল/ বিধ্বস্ত নিঝুমদ্বীপের ৩০ হাজার অধিবাসীর মানবেতর জীবন

একমাত্র আশ্রয়স্থল ঘরটি হারিয়ে চার সন্তান নিয়ে পাশের গ্রামে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন মোল্লা গ্রামের তাসলিমা বেগম। ধুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া ঘরের চাল ছাড়া বেড়া পড়ে আছে ভিটের ওপর। ঘরের মালামাল জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। ঝড় থেমে গেলেও দুর্ভোগ থামেনি তাসলিমা বেগমের পরিবারের। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা গরিব-অসহায়। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আমাদের দেখার কেউ নাই।’

এদিকে ঘূর্ণিঝড়ে প্রবেশ করা জোয়ারের পানি আটকে এখন গরমে বিষাক্ত বাষ্প ছড়াচ্ছে। নানা ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন দ্বীপের বাসিন্দারা। কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকায় তারা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন আসছে না বলেও অভিযোগ বাসিন্দাদের।

ঘূর্ণিঝড় রিমাল/ বিধ্বস্ত নিঝুমদ্বীপের ৩০ হাজার অধিবাসীর মানবেতর জীবন

হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড় রিমালে দ্বীপের ১৯১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে আধাপাকা ২৭০ ও কাঁচা তিন হাজার ২২৮টি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ৩৩ হাজার পরিবার কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ভেসে গেছে চার হাজার ৮৭৬টি। আট হাজার পাঁচ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ৩৮০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, প্রায় ৫০০ কিলোমিটার রাস্তাসহ ১১টি কালভার্ট ও ১৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ধসে গেছে। ৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ১৩৫টি টিউবওয়েল ও ২৮৫টি নৌকা-ট্রলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুভাশীষ চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, দ্বীপের ১১ ইউনিয়ন ও এক পৌরসভার মধ্যে পাঁচটিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এগুলো হলো নিঝুমদ্বীপ, সুখচর, নলচিরা, হরনী ও চানন্দী। উপজেলায় মোট ২১১ কোটি ৪৬ লাখ ১৫ হাজার ৯৮৩ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানানো হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমাল/ বিধ্বস্ত নিঝুমদ্বীপের ৩০ হাজার অধিবাসীর মানবেতর জীবন

তবে প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা এলাকায় না যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আপনারা খোঁজখবর নিয়ে দেখেন আমাদের লোকজন মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। প্রয়োজন হলে আমরাও যাবো।’

জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার জাগো নিউজকে বলেন, আমরা নিঝুমদ্বীপে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী পাঠানো হয়েছে। কোথাও না পৌঁছালে খুব শিগগির পৌঁছানোর জন্য হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমাল/ বিধ্বস্ত নিঝুমদ্বীপের ৩০ হাজার অধিবাসীর মানবেতর জীবন

জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, হাতিয়াসহ উপকূলীয় সব ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলায় সরকারি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানো এবং দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছেন হাতিয়া দ্বীপের সাত লাখ অধিবাসী। এবারের ঘূ্র্ণিঝড় রিমালে সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পুনর্গঠনে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছি। এখানকার মানুষ ত্রাণের চেয়েও বেশি চান স্থায়ী বেড়িবাঁধ। বিষয়টি উচ্চ পর্যায়ে জানানো হয়েছে।

এসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।