সুপেয় পানির অভাবে উপকূল ছাড়ছে মানুষ
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জের সুন্দরবন সংলগ্ন মালঞ্চ নদীর তীরে বেড়িবাঁধের পাশে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলেকে নিয়ে বসবাস সুফিয়া বেগমের। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর তিনটি ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ঘর। প্রতিবার নতুন করে ঘর তৈরি করতে হয়েছে।
সুফিয়া বেগমদের এলাকায় বর্তমানে সুপেয় পানি পাওয়া যায় না। খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয় কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে। গোসল, রান্নাসহ দৈনন্দিন কাজ সারতে হয় জমিয়ে রাখা বৃষ্টির পানি অথবা দূরের কোনো পুকুর থেকে সংগৃহীত পানি দিয়ে। শুধু পানির কারণে বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগে আক্রান্ত হয়েছেন সুফিয়া বেগম।
এই পরিবারটির মতোই নদী তীরবর্তী এলাকায় বসবাসরত পরিবারগুলো একই সমস্যায় ভুগছে। একদিকে সুপেয় পানির তীব্র সংকট, অন্যদিকে দুর্যোগ এলে বেড়িবাঁধ ভেঙে সর্বস্ব হারানোর শঙ্কা নিয়েই বসবাস তাদের। তবে যাদের আর্থিক অবস্থা একটু ভালো তারা ভিটেমাটি ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে শহরে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের কলবাড়ি জেলেপল্লি এলাকায় সবসময় আসা-যাওয়া করে জোয়ার-ভাটার পানি। ছবি : জাগো নিউজ
সুফিয়া বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় বাঁধ ভেঙে সবকিছু পানিতে তলিয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর বসতবাড়ি ভেঙে যায়। নতুন করে ঘর করতে উচ্চ সুদে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। এক বছর পর সুদে আসলে ১৫ হাজার টাকা শোধ করতে হয়েছে। আবার ঝড় এলে সেটিও থাকবে কি না, সেই শঙ্কা নিয়েই বসবাস করতে হয়। তাছাড়া খাবার পানির কষ্ট পোহাতে হয় সারা বছরই।
আরও পড়ুন
- উজান থেকে আসা প্লাস্টিকে ধুকছে পরিবেশ
- পরিবেশ বিপর্যয়ে পেশা বদলাচ্ছেন কৃষক
- শীর্ষ দূষণের শহর ঢাকা বসবাসেরও অযোগ্য
- গাছ না লাগালে পরীক্ষায় ফেল
সুফিয়া বেগম বলেন, ‘আমার নিজের কোনো জমি নেই। এজন্য বাধ্য হয়ে এখানে বসবাস করতে হয়। তবে যাদের এখানে জায়গা-জমি আছে, তারা সবাই লবণ পানি তুলে মাছ চাষ করে। যারা টাকা-পয়সার মালিক তারা কেউ এই এলাকায় থাকে না। তাদের সবার শহরে বাড়ি আছে।’
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলের যত্নে ব্যস্ত মা সুফিয়া বেগম। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জের সুন্দরবন সংলগ্ন মালঞ্চ নদীর তীরে বেড়িবাঁধের পাশে বাস করেন তারা। ছবি : জাগো নিউজ
মুন্সিগঞ্জ থেকে দক্ষিণে এই উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। গাবুরার চারপাশ ঘিরে রেখেছে খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদ। গাবুরার চকবারা গ্রামে যেতে হয় নীলডুমুর খেয়াঘাট থেকে খোলপেটুয়া নদী পার হয়ে। ঘূর্ণিঝড় আইলায় চকবারা গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে লবণ পানি প্রবেশ করে। কয়েক মাস ধরে চলে জোয়ার-ভাটা। আইলার আগে গ্রামটিতে তিন শতাধিক পরিবারের বসতি থাকলেও বর্তমানে ১২০ পরিবার। অধিকাংশ পরিবারের মানুষ এ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।
এই গ্রামের বাসিন্দা আলতানুর গাজী জাগো নিউজকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার আগে তাদের গ্রামে প্রচুর ধান চাষ হলেও এখন পুরোটাই লবণ পানির চিংড়ি চাষ হয়। গ্রামটির কোথাও খাওয়ার মতো পানির উৎস নেই। দেড় কিলোমিটার দূরের একটি পুকুর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন স্থানীয়রা।
এছাড়া সরকারি-বেসরকারি সংস্থা থেকে পাওয়া প্লাস্টিকের ট্যাঙ্কে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করেন অনেকে। এই অল্প পরিমাণ পানি দিয়ে জীবন ধারণ খুবই কষ্টসাধ্য। এখানকার পানি অতিমাত্রায় লবণাক্ত হওয়ায় নানা ধরনের চর্ম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় বাধ্য হয়ে অনেক মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে গেছে। যাদের উপায় নেই তারাই এখানে রয়েছে। এখানে যারা বসবাস করছে তাদের সবাই সুন্দরবন ও নদীতে মাছ শিকারের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া যাদের জায়গা-জমি আছে তারা সবাই লবণ পানির মাছ চাষ করছে।
আরও পড়ুন
সাতক্ষীরার আরেক উপকূলীয় উপজেলা আশাশুনির চিত্রও একই রকম। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও ইয়াসের সময় নদীর বাঁধ ভেঙে প্রতাপনগর ইউনিয়নের অন্তত ১০টি গ্রামে ছয় মাস জোয়ার-ভাটা হয়েছে। বাঁধটি সংস্কার করা হলেও সেখানকার মানুষ এখনও নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লে আতঙ্কে থাকে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রাম। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙে লোনা পানি প্রবেশ করে। ছবি : জাগো নিউজ
প্রয়োজন টেকসই বেড়িবাঁধ
আশাশুনির একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্য তৌসিকে কাইফু জাগো নিউজকে বলেন, ‘আশাশুনি উপজেলার কিছু বাঁধ নতুন করে নির্মাণ করা হলেও অধিকাংশ এলাকায় বেড়িবাঁধ ঝুঁকিতে আছে। আমাদের এলাকার মানুষের অভাব নেই তবে আতঙ্ক আছে। বর্তমানে সবচেয়ে বড় আতঙ্ক জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ ভাঙনের। কারণ বাঁধ ভাঙলে ঘের ও খাবার পানির উৎস নষ্ট হয়ে যায়। লোকালয়ে লবণ পানি প্রবেশ করলে মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। আমাদের দাবি একটাই, বাঁধ ভাঙলে ত্রাণ দরকার নেই। আমাদের দরকার টেকসই ও স্থায়ী বেড়িবাঁধ।’
শ্যামনগরের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সিডিওর পরিচালক গাজী আল ইমরান জাগো নিউজকে বলেন, উজানের পানি না আসায় এই এলাকার নদীর পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বেশি। এজন্য এখানকার জমিতে ধান বা অন্য ফসল হয় না। মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থান নেই। বেশির ভাগ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস নদীতে রেণুপোনা সংগ্রহ, মাছ ও কাঁকড়া ধরা।
আরও পড়ুন
- বিশ্ব পরিবেশ দিবস/দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গাছ লাগানোর নির্দেশ
- বর্ষায় ৮ কোটি ৩৩ লাখ চারা রোপণ করা হবে
গাজী আল ইমরান বলেন, উপকূলবাসীর এলাকা ছাড়ার প্রধান কারণ সুপেয় পানি ও বেড়িবাধেঁর পাশে বসবাসের অনিশ্চয়তা। টেকসই বাঁধ নির্মাণ হলে মানুষ এলাকা ছাড়ত না।
২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দুর্গাবাটি গ্রামের বাঁধ ভেঙে যায়। ফাইল ছবি : জাগো নিউজ
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকার চিত্র বদলে গেছে। সেখানে চিংড়ি চাষ করতে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ কেটে লবণ পানি প্রবেশ করিয়ে ফসলের মাঠগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। প্রায় প্রতি বছর ওই এলাকার উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে লবণ পানি প্রবেশ করছে। ঘূর্ণিঝড় আইলা, ফণী, মহাসেন, আম্ফান, ইয়াসের আঘাতে উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হয়েছে। এসব এলাকার অনেক পরিবার জমি ও সম্পদ হারিয়ে দরিদ্র হয়েছে। লবণাক্ততার কারণে উপকূলের মানুষের খাবার পানির জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, উপকূলীয় এলাকায় এখনই টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হলে নতুন নতুন এলাকায় লবণ পানি প্রবেশ করবে। এছাড়া সুপেয় পানির ব্যবস্থাসহ বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে মানুষ ওই এলাকা ছেড়ে শহরমুখী হবে।
উপকূলবাসীকে রক্ষায় উদ্যোগ
যোগাযোগ করা হলে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির জাগো নিউজকে বলেন, উপকূলবাসীকে রক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে এক হাজার ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে গাবুরা ইউনিয়নের চারপাশে ২৯ কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। বাঁধের ২৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ হবে। সেটি শেষ হলে গাবুরার চিত্র বদলে যাবে।’
জেলা প্রশাসক বলেন, পর্যায়ক্রমে অন্য এলাকার বাঁধগুলোর নির্মাণ কাজও শুরু হবে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় চাষাবাদ ও খাবার পানি সংরক্ষণের জন্য খাল খনন, পুকুর খনন, আধুনিক পানির প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে প্লাস্টিকের ট্যাঙ্কি বিতরণসহ একাধিক প্রকল্প চলমান।
আহসানুর রহমান রাজীব/এমএমএআর/এমএস