মানুষ জেগে উঠলেই সব নদী বাঁচবে, পরিবেশ বাঁচবে
সবার চোখের সামনে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার নদী দখল হচ্ছে। তারা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে। এমনকি নদীপাড়ের যে মানুষ, তার যে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব সেও ঘুমিয়ে আছে। নাগরিক না জাগলে বাংলাদেশের নদীও বাঁচবে না, প্রকৃতিও বাঁচবে না।
কথাগুলো বলেছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, গবেষক ও সংগঠক ড. তুহিন ওয়াদুদ। পরিবেশ দূষণ ও নদীরক্ষা বিষয়ে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক জিতু কবীর।
ড. তুহিন ওয়াদুদ নদী ও পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক। নদী ও পরিবেশ রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন তিনি। উদ্ভিদ সংরক্ষণ, নদীবিষয়ক গবেষণা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২০ সালে দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ পুরস্কার এবং পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা ও প্রচার এবং পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অসামান্য অবদান রাখায় ২০২৩ সালে জাতীয় পরিবেশ পদক পেয়েছেন।
জাগো নিউজ: রংপুর অঞ্চলের পরিবেশ কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে?
ড. তুহিন ওয়াদুদ : পরিবেশের ব্যাপারটা তো একটা নির্দিষ্ট অঞ্চল ঘিরে হয় না। এটার সঙ্গে একটা সামষ্টিক ব্যবস্থাপনা থাকে। এটার সঙ্গে দেশ-বিদেশ, একটা অখণ্ড পৃথিবীর সঙ্গে এটা যুক্ত। কিন্তু আমরা যদি রংপুরকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে চাই যে রংপুরের ঝুঁকিগুলো কোথায়, রংপুরের অসুবিধাগুলো কোথায়। তাহলে সেই জায়গায় কিছু কিছু কথা বলার সুযোগ আছে। রংপুর যেহেতু কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক জায়গা, আমরা যদি দেখি, গোটা রংপুর বিভাগে কিছু কলকারখানা নির্দিষ্ট কিছু ছোট ছোট জায়গায় গড়ে উঠেছে। বিশাল আয়তনের এ জায়গায় কিন্তু শিল্প কারখানা খুব বেশি গড়ে ওঠেনি। তারপরও সেগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা আছে। সৈয়দপুরে কলকারখানা আছে। আমরা দেখেছি সেখানে খড়খড়িয়া নদী রয়েছে। সেই নদীতে প্রচুর দূষণ আছে। যদি রংপুর বিভাগের জেলা শহরগুলোর কথা বলি তাহলে দেখবো, লালমনিরহাটের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে সতী নদী। যার অবস্থা খুবই করুণ, খুবই ভয়াবহ। আমরা যদি রংপুরের কথা বলি তাহলে বলতে হয়, ঘাঘট, খোকসা ঘাঘট, ইছামতী, আলাইকুমাড়ি, বুড়াইলসহ অনেকগুলো নদী আছে। কিন্তু আমরা এই নদীগুলোর পরিচর্যা করতে পারিনি। দখল ও দূষণ আছে। পঞ্চগড়ের দিকে যদি তাকাই দেখবো সেখানে করতোয়া নদী। নীলফামারীতে বামনডাঙ্গা নদী। দখল দূষণে সর্বনাশের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে বামনডাঙ্গা। ঠাকুরগাঁওয়ে টাঙ্গন নদী। সেই টাঙ্গন নদীর অবস্থাও ভালো নয়। গাইবান্ধার পাশ দিয়ে ঘাঘট, নীলফামারীর পাশ দিয়ে বামনডাঙ্গা, দিনাজপুরের পাশ দিয়ে পুনর্ভবা, রংপুরের পাশ দিয়ে ঘাঘটসহ অন্য নদী আছে। কুড়িগ্রামের পাশ দিয়ে ধরলা নদী। এরকম সব নদীর পাশেই শহর। ধরলার হয়তো এখন অবস্থা ভালো। কিন্তু দূর ভবিষ্যতে এর অবস্থা খারাপের দিকেই যাচ্ছে।
জাগো নিউজ: পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ কোনটা বলে মনে করেন?
ড. তুহিন ওয়াদুদ: পরিবেশ দূষণের জন্য নানান অব্যবস্থাপনা জড়িত। আমরা আমাদের গাছপালাগুলো রক্ষা করছি না। রংপুর অঞ্চলের যেখানেই যাই শুনি একসময় বনাঞ্চল ছিল, জলাশয় ছিল, নদী ছিল। এখন নেই। তাহলে আমরা নদী মেরেছি, জলাশয় মেরেছি, আমাদের বনাঞ্চল মেরেছি। আমাদের জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনজীবন ব্যবস্থাপনায় যে বিষয়গুলো পরিবেশের ক্ষতি করে সেটা নদীতে ফেলেছি। আমরা প্লাস্টিক ব্যবহার করছি। এমন নানাভাবে আমরা আমাদের পরিবেশটা খারাপের দিকে নিয়ে গিয়েছি। এই খারাপের দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নদী একটা বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। কারণ, আমাদের যে মাটির গঠন, প্রকৃতির যে ধরন, যে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি এসবের সঙ্গে কিন্তু নদীর সম্পর্ক। পলিমাটি দিয়ে গড়া এই বাংলাদেশ। সেখানে যদি নদী না থাকে তাহলে তো মাটির গঠনই বদলে যায়।
জাগো নিউজ: রংপুর অঞ্চলে প্রকৃত নদ-নদীর সংখ্যা কত?
ড. তুহিন ওয়াদুদ: এটি একটি সহজ জিজ্ঞাসা। পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের বইয়ে রংপুর বিভাগে ৮৩টি নদীর কথা উল্লেখ করেছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন একটা বই প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা ১৩১টির মতো নদীর কথা উল্লেখ করেছে। আমাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, রংপুর বিভাগে কতগুলো নদী আছে। তাহলে আমরা সরেজমিনে, একবারে নদীর পাড়ে পাড়ে গিয়ে যে নদীর সংখ্যা পেয়েছি, সেই নদীর সংখ্যা প্রায় ৩০০। এখন যদি বলা হয়, এই ৩০০ নদীর মধ্যে ভালো নদী আছে কতটা? তাহলে এক কথায় উত্তর-একটা নদীও ভালো নেই। যদি বলা হয় সবচেয়ে খারাপ নদী কোনটা, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত নদী কোনটা? তাহলে আমাদের বলতে হবে, তিস্তা হচ্ছে সবচেয়ে সংকটাপন্ন। দখল-দূষণে অন্য নদী। কিন্তু তিস্তাকে আমরা কেন সংকটাপন্ন বলছি? কারণ তিস্তা হচ্ছে উত্তরের জীবনরেখা। এই নদীর বয়স ২৩৬ থেকে ২৩৭ বছর। ১৭৮৭ সালে মহাপ্লাবনে যখন প্রচুর বৃষ্টির পানি করতোয়া, পুনর্ভবা, আত্রাই আগের মতো পানি ধারণ করতে পারেনি তখন এই পানি দিয়ে তিস্তা নদী তৈরি হয়েছে। একটা সময় এই নদীটা ভালোই ছিল। কিন্তু ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে। এখন যে পানি আমরা পাই সেটা চুয়ে চুয়ে আসা। পানি প্রত্যাহার করায় তিস্তার ভাটির দিক মরে যাচ্ছে। জীবনরেখার যদি মরণদশা হয় তাহলে মানুষের জীবনও মরণদশার দিকে যাবে-এটাই খুব স্বাভাবিক।
জাগো নিউজ: নদী দূষণের অন্যতম কারণ?
ড. তুহিন ওয়াদুদ: নদী দূষণের যে কারণগুলো তার মধ্যে কলকারখানার বর্জ্যের একটা প্রভাব রয়েছে। নীলফামারীর সৈয়দপুরের খড়খড়িয়া নদীর ওপর এর সরাসরি প্রভাব আছে। যদি রংপুরের কথা বলি তাহলে শ্যামাসুন্দরীর কথা বলতে হয়। নদী বিশেষজ্ঞরা যদিও এটাকে নদী বলেন, আর প্রচলিত অর্থে এটি খাল। খাল হোক বা নদীই হোক, এটা প্রাকৃতিক প্রবাহ। এই প্রাকৃতিক প্রবাহটা আমরা শহরের দূষিত পানি, ব্যবহৃত পলিথিন ও বাড়ির ময়লা-আবর্জনা দিয়ে বন্ধ করে ফেলেছি। আমরা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় দেখি, পানি উল্টো দিকে যাচ্ছে। একটা সহজ কথা, যদি একটা প্রবাহ তার প্রাণটা হারিয়ে ফেলে তাহলে ময়লা-আবর্জনা যাই ফেলা হোক না কেন সেটা স্তূপ হয়। স্তূপ হতে হতে ঘাঘটের যে শাখা নদী সেই ঘাঘটের তলদেশ থেকে শ্যামাসুন্দরীর তলদেশ ২০ ফিট উঁচু। তাহলে যে পানি নেবে তার তলদেশ যদি উঁচু হয় সে পানি পাবে কোথায় থেকে? এটার সঙ্গে সম্পর্ক আছে তিস্তা নদীর। নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার শৌলমারী ইউনিয়নের আলশিয়াপাড়া গ্রামে এ ঘাঘট নদীর মুখ বন্ধ করে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ফলে তিস্তার পানি ঘাঘটে আসে না। ঘাঘটে যখন পানি কমে যায় তখন সে শ্যামাসুন্দরীকে পানি দিতে পারে না। শ্যামাসুন্দরী যখন পানি পায় না তখন সেটা একটা ক্যানেলে পরিণত হয়। আমাদের এখানে যে দূষণ, সেই দূষণের কারণ মানুষের সৃষ্টি। নানারকম ময়লা-আবর্জনা ফেলে, দূষিত পানি ফেলে পানির প্রবাহ বন্ধ করে এই দূষণটা তৈরি করা হয়েছে। আমাদের ঘাঘটে দূষণ আছে, শ্যামাসুন্দরীতে দূষণ আছে, খোকসা ঘাঘটে দূষণ আছে, কেডি খালে দূষণ আছে। আমাদের মাহিগঞ্জের আলাইকুমারী নদীতে দূষণ আছে। ইছামতিতে দূষণ আছে। এরকম নানা দখল-দূষণে আমাদের নদীগুলো মরতে বসেছে।
জাগো নিউজ: আন্তসীমান্ত নদী কতগুলো এবং বর্তমান অবস্থা কী?
ড. তুহিন ওয়াদুদ: রংপুর বিভাগে স্বীকৃত আন্তসীমান্ত নদী ১৮টি। সারাদেশে স্বীকৃত আন্তসীমান্ত নদীর সংখ্যা হচ্ছে ৫৭টি। এরমধ্যে বাংলাদেশ-ভারত মিলে ৫৪টি। আমরা এই ৫৪টি নদীর মধ্যে রংপুর বিভাগে পেয়েছি ১৮টি স্বীকৃত আন্তসীমান্ত নদী। কিন্তু এই স্বীকৃত ১৮টির বাইরে আরও অন্তত ৩৬টি নদী আছে, যেগুলোর পাড়ে আমরা গিয়েছি। আমাদের এই আবিষ্কৃত ৩৬টি নদীর বাইরে আরও আন্তসীমান্ত নদী থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। সেই হিসাব থেকে আমরা বলতে পারি, রংপুর বিভাগে আন্তসীমান্ত নদীর সংখ্যা অবশ্যই ৫০ এর অধিক। কিন্তু এখানকার আন্তসীমান্ত নদীগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
জাগো নিউজ: পরিবর্তিত জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্ত হতে আমাদের করণীয়?
ড. তুহিন ওয়াদুদ: জলবায়ুর যে বিরূপ প্রভাব সেটা তো আসলে বিশ্বব্যাপী। সেই বিশ্বব্যাপী প্রভাব থেকে এ অঞ্চল তথা বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলের নীতি ও প্রচেষ্টা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। আমাদের যখন তিস্তা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্রে পানি থাকে না তখন কিন্তু সমুদ্রে পানির চাপ কমে যায়। কারণ, এই পানিই তো সমুদ্রে যায়। সমুদ্রে পানির চাপ যখন কমে যায় তখন লোনা পানি উপরে উঠে আসে। লোনা পানি যখন উপরে উঠে আসে তখন তা ওখানকার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে। আমরা তিস্তা সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে চাষাবাদ করি এবং এতে লাভ হয়। কিন্তু সমুদ্রে পানি না গেলে যে ক্ষতি হয় সেটা কি কখনো হিসাব করেছি? তিস্তা সেচ প্রকল্প যদি নীলফামারী জেলার জন্য উপকারী হয় তাহলে সেটা সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার জন্য কতখানি ক্ষতি সে হিসাব কিন্তু করা হয়নি।
জাগো নিউজ: নদী দখল-দূষণে বিদ্যমান আইন কতটা কার্যকর?
ড. তুহিন ওয়াদুদ: নদী দখল-দূষণ থেকে রক্ষার জন্য আমাদের যে বিদ্যমান আইন আছে তার যদি প্রয়োগ থাকতো তাহলে এটা রক্ষা করা সম্ভব হতো। সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে আমাদের প্রশাসনিক যে কাঠামো এ কাঠামোতে একটা নদীও রক্ষা করা সম্ভব নয়। এর একটা কারণ যদি বলি, ভূমি জরিপ অধিদপ্তর বলতে সরকারের একটা প্রতিষ্ঠান আছে। এই ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের অনেক কাজের মধ্যে একটা কাজ হলো নতুন রেকর্ড প্রকাশ করা। তারা যে আরএস রেকর্ড বলে একটা প্রকাশ করছে, এই আরএস রেকর্ডে রংপুর বিভাগে যদি ৩০০ নদী থাকে তাহলে ৩০০ নদীরই অনেক জায়গার মালিকানা, কোথাও কোথাও পুরো নদী ব্যক্তির নামে রেকর্ড করেছে। তারা বলে-ইউএনও পাঠিয়েছে, ডিসি পাঠিয়েছে। আমরা সেগুলো দেখে দেখে এই কাজ করি। একটা সিএস নকশা তো ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের কাছে আছে। এই নদীর শ্রেণি পরিবর্তনের আইনগত ভিত্তি কোনোদিন ছিল না। ওরা যদি সিএস নকশা দেখে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ হিসাব করে নতুন রেকর্ডেও তা অন্তর্ভুক্ত করতো তাহলে হতো। কিন্তু তারা এ কাজ করেনি। আর আমাদের ইউএনও ও জেলা প্রশাসক অনেক কাজে ব্যস্ত থাকেন। তারা এই নদী দখল আর দূষণ থেকে রক্ষার বাড়তি দায়িত্ব নিতেও চান না, সেই সুযোগও নেই। আমি ১৫ বছর ধরে নদী নিয়ে কাজ করি। একজন ডিসি বা ইউএনওকে দেখিনি যে, তারা নিজ চেষ্টায় তার অঞ্চলের নদীগুলো রক্ষা করতে সাহসী কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে অসংখ্য নদী ব্যক্তিকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে যেগুলো জায়গায় উদ্ধার করতে পেরেছি সেখানে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা মানে আন্তরিকতা না থাকলে হতো-এটা নয়। কিন্তু এ খবরটা আমাদের দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা উচিত ছিল। অসংখ্যবার লিখিত দেওয়া, অসংখ্যবার কর্মসূচি গ্রহণ করা-এগুলো লাগবে কেন? যখন ডিসি বা ইউএনও জানলেন যে, এটা দখলে আছে। তখন উনারা উদ্ধারে কাজ শুরু করবেন। কিন্তু তা করেন না। তখন আমাদের চিঠি দিতে হয়, স্মারকলিপি দিতে হয়। সংবাদ সম্মেলন করতে হয়। লেগে থাকতে হয়। লেগে থাকতে থাকতে কোনো ডিসি আসেন, আন্তরিকতা দেখান। আবার কেউ কেউ এসব মাথায় নিতে চান না। নানা বাস্তবতার ভেতর দিয়ে আমরা যাই। জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন নদীর সংখ্যা নিয়ে যে বই বের করেছে সেটা খুবই দুর্বল একটা বই হয়েছে, ভুল হয়েছে। এটা নিষিদ্ধ করা উচিত। এটা থাকলে মানুষ রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ করবে। এটাকে নিষিদ্ধ করে পূর্ণাঙ্গ একটা তালিকা প্রকাশ করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
জাগো নিউজ: বিভিন্ন সময়ে নদীর আয়তন ছোট করা হচ্ছে, মেরে ফেলা হচ্ছে-এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ড. তুহিন ওয়াদুদ : ধরা যাক, এলজিইডি যখন সড়কের কাজ করে তখন যত জায়গায় নদী আছে তারা নদীর মাপের চেয়ে ব্রিজটা ছোট করে ফেলে। ধরুন, ৫০ কিলোমিটার প্রবাহমান একটা নদীর ১০ জায়গায় যদি ছোট ছোট করে বাঁধ দেওয়া হয় তাহলে ওই জায়গায় গিয়ে পানি ধাক্কা খায়। তখন সেখানে পলি জমে স্তূপ হয়। এভাবে তারা নদীর ক্ষতি করে। আবার যখন একটা ছোট সেতু দেওয়া হয় তখন দখলদাররা ওই সেতুটার মাপটা মনে করে এটাই হচ্ছে নদীর মাপ। এরপর থেকে তারা দখল শুরু করে। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড তো অনেক নদীর উৎসমুখ বন্ধ করে দিয়েছে, মিলনস্থল বন্ধ করে দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রচুর নদী খেয়ে ফেলেছে। খনন প্রক্রিয়ায় বিএডিসি, বরেন্দ্র, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এলজিইডি নদীর আরেকটা সর্বনাশ করছে। নদীর সঠিক মাপ না নিয়ে খনন করায় দখলদাররা সুযোগ পাচ্ছে। নদীর একটা প্রবাহকে তারা তিন ভাগে ভাগ করেছে। আবার অনেকে নদী খনন করে বালু নদীর পাড়েই ফেলছে। পরে সেই বালু আবার নদীতেই চলে যায়। অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিকভাবে নদীর কাজ করা হচ্ছে যে, সেটা বলার মতো নয়।
জাগো নিউজ: পরিবেশ ও অর্থনীতিতে তিস্তা মহাপরিকল্পনার গুরুত্ব কতটা?
ড. তুহিন ওয়াদুদ: তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা শুনছি ২০১৬ সাল থেকে। আট বছর হয়ে গেলো। সেসময় টাকা লাগ তো সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। ঠিক ওই সময় সারাদেশে তিন লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। আমরা বলছি যে, তিন লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পে এক বছরে যে সাশ্রয় বা লাভ হয় বাংলাদেশের তার চেয়ে বেশি লাভ হতো তিস্তায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করলে। কিন্তু এখনো সেটা হয়নি। কারণ, এখানে প্রভাবক রাজনীতিবিদ নেই, এখানে প্রভাবশালী আমলা নেই। এখানকার মানুষের দাবি-দাওয়া জানানোর মতো কোনো মানুষ নেই। সবদিক থেকে অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত জায়গার নাম হচ্ছে রংপুর। তিস্তা মহাপরিকল্পনা যদি রংপুর ছাড়া দেশের অন্য কোথাও হতো তাহলে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কোনো ব্যাপার ছিল না। আমরা বলছি, প্রতি বছর তো এক লাখ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। তাহলে গত আট বছরে আট লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এজন্য তিস্তা মহাপরিকল্পনা খুবই দরকার। বিজ্ঞানসম্মতভাবে দরকার। নদী বাঁচিয়ে রাখা, জীববৈচিত্র্য বাঁচিয়ে রাখা, কৃষি বাঁচিয়ে রাখা, কৃষিনির্ভর অর্থনীতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য এ মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন চাই।
জাগো নিউজ: পরিবেশ ও নদী রক্ষায় করণীয় কী?
ড. তুহিন ওয়াদুদ: প্রধানমন্ত্রী যতবার নদী রক্ষার জন্য অনুশাসন দিয়েছেন, এ অনুশাসন পালনের জন্য বাংলাদেশের কোনো কর্মকর্তা দায়িত্ব নিয়েছেন বলে আমাদের মনে হয় না। কোনো রাজনীতিবিদকে স্থানীয়ভাবে বলতে শুনিনি যে, প্রধানমন্ত্রী পানি বাধাহীন করতে বলেছেন। আমি আমার এলাকার সব নদীর পানি বাধাহীন করতে চাই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের কথা নদীর ক্ষেত্রে কেউ পালন করে না। অথচ আমরা দেখছি, তিস্তা নদীতে বিশাল বিশাল প্রকল্প হচ্ছে। সেগুলো কতখানি নিয়ম মেনে হচ্ছে, কতখানি নিয়ম ছাড়া হচ্ছে? একদম জেলা প্রশাসক, ইউএনওর নাকের ডগায়, চোখের সামনে এসব হচ্ছে। সবাই তাকিয়ে দেখছে। কী এক বিস্ময়কর বাংলাদেশ। সবার চোখের সামনে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার দখল হচ্ছে। তারা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে। এমনকি নদীপাড়ের যে মানুষ, তার যে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব সেও ঘুমিয়ে আছে। নাগরিক না জাগলে বাংলাদেশের নদীও বাঁচবে না, প্রকৃতিও বাঁচবে না। ক্রমাগত আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। কিছু মানুষ পয়সা বানাবে। তাদের বাড়ি, গাড়ি সবকিছু থাকবে বাইরে। তাদের এখানকার জন্য কোনো মায়াকান্না নেই। এজন্য এখানকার জন্য নদীপাড়ের যে সাধারণ মানুষ আছে তাদের জেগে উঠতে হবে। যে দেশের ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়ে একটা বাংলাদেশ জন্ম দিতে পারে সে দেশে ৩০ লাখ মানুষও লাগে না। তারা জেগে উঠলেই বাংলাদেশের সব নদীই বাঁচবে, পরিবেশ বাঁচবে।
জেডআইকে/এমএমএআর/জিকেএস