এমপি আনার হত্যা

মাস্টারমাইন্ড শাহীনের বাগানবাড়িতে মাঝরাতে বাজতো গান, ঢুকতো গাড়ি

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ঝিনাইদহ
প্রকাশিত: ১০:২৯ পিএম, ২৩ মে ২০২৪

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা শহর থেকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে এলাঙ্গী গ্রামের নির্জন মাঠ। মাঠ পেরিয়ে চার পাশে জঙ্গল, কাঁটাতার ও ফুলে ঘেরা বেড়া। ভেতরের আমবাগানের এক প্রান্তে বিলাসবহুল দ্বিতল বাড়ি, যা দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। বাড়ির দ্বিতীয় তলার অধিকাংশ স্থানই কাঁচঘেরা। ঝুলছে বড় বড় পর্দা। অপর প্রান্তে দেখা যায়, একটি টিনশেড। যার সামনে ছাউনির নিচে রাখা আছে সাদা রঙের গাড়ি। প্রায় চার বছর আগে এ বাংলো বাড়িটি গড়ে তুলেছিলেন এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আক্তারুজ্জামান শাহীন।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্রামে এলে তিনি এই বাড়িতেই থাকতেন। তবে বাড়ির ভেতরে কী হতো, সেটি কখনো দেখতে পারেননি তাঁরা। তবে মাঝেমধ্যেই রাতের বেলায় বড় বড় গাড়ি ঢুকতো সেখানে। বেজে উঠতো গান। তবে থানা-পুলিশ কিংবা আইনের ভয়ে কেউই কখনো মুখ খোলেননি।

কোটচাঁদপুর উপজেলা ও এলাঙ্গী গ্রাম ঘুরে জানা যায়, শাহীনের বাবা আসাদুজ্জামান। তিনি আড়তদারি ব্যবসা এবং কৃষিকাজ করতেন। তার তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে সহিদুজ্জামান সেলিম থাকেন কোটচাঁদপুর শহরের বাজারপাড়ার বাড়িতে। তিনি ব্যবসা করেন এবং তিনি কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র। আরেক ছেলে মনিরুজ্জামান মনির ১৯৮৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট শহরে থাকেন, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। মেয়ে খুকু থাকেন কখনো কানাডা, আবার কখনো ঢাকায়। ছোট ছেলে আক্তারুজ্জামান শাহীন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী। অপর মেয়ে এলিন থাকে ঢাকায়।

আক্তারুজ্জামান শাহীন এলাকার কোটচাঁদপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং কে এম এইচ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে লেখাপড়া শেষে দুই বছর পড়াশোনা করে জাহাজে চাকরি নেন। চাকরির দুই বছরের মাথায় ‘ওপি ওয়ান’ নামের লটারির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ পান। এরপর থেকে সেখানে বসবাস করেন তিনি, সেখানকার নাগরিকও।

তবে তিনি কত সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি তার বড় ভাই। যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সুবাদে জড়িত হন নানা ব্যবসার সঙ্গে। বিভিন্ন ধরনের মালামাল বাংলাদেশ, ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি-রপ্তানি করতেন তিনি। এসব দেশে তার যাতায়াতও ছিল। গেলো পৌরসভা নির্বাচনের সময় ভাইয়ের পক্ষে (সহিদুজ্জামান সেলিম) ভোটের আগে-পরে কয়েকদিন বেশ সক্রিয় ছিলেন শাহীন।

গেলো ৪ বছর আগে কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামে নিজের ও পরিবারের প্রায় (বেশির ভাগ জমির অংশ শাহীনের) ৩০ বিঘা জমিতে গড়ে তোলেন বাংলো, দ্বিতল বিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়ি। এলাকায় এলে সেখানেই থাকতেন। এ জমি একসময় ইটের ভাটা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পরে ভাটা বন্ধ হলে পারিবারিকভাবে জমির অংশ পান তিনি। এ বাংলোর ভেতরে রয়েছে পুকুর, গরুর খামার। রিসোর্ট হিসেবেও এটিকে রূপান্তরের পরিকল্পনা ছিল তার।

বৃহস্পতিবার কোটচাঁদপুর শহরের বাজারপাড়ার বাসায় কথা হয় শাহীনের বড় ভাই পৌর মেয়র সহিদুজ্জামান সেলিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, শাহীনের সঙ্গে সর্বশেষ ছয়দিন আগে কথা হয় হোয়াটসঅ্যাপে। পারিবারিক খোঁজখবর। তবে শাহীন তখন কোনো দেশে ছিলেন তা জানি না। শাহীনের স্ত্রী সন্তানরা মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসেন। শাহীন এলাঙ্গীতে বাংলো বাড়ি করার পর আমার বাড়িতেও থাকে না। সর্বশেষ ৬ মাস আগে থেকেছে একরাত।

তিনি আর বলেন, শাহীন এত বড় একটি ঘটনা ঘটাবে এটা বিশ্বাস হয়নি আমাদের। প্রশাসনের উচিত সঠিক তদন্ত করা। যদি ভাই দোষী হয় তাহলে প্রচলিত আইনে তাকে শাস্তি দেওয়া হোক, এটা আমরা চাই। এমপি আনারের সঙ্গে তার একটা পারিবারিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। যেটা আমি জানতে পেরেছি গত ৫/৬ বছর আগে। তবে, কি ব্যবসা ছিল তা আমরা কখনো জানতে পারিনি।

এদিকে, শাহীনের এলাঙ্গী গ্রামের বাগানবাড়িতে গিয়ে দেখা যায় গেট তালাবদ্ধ। পাওয়া যায়নি বাড়ির দারোয়ানকেও। তবে সেখান থেকে সফিউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি বলেন, লোকজন আসে গেটের ভেতরে ঢোকে। মাঝে মাঝে রাতে গান-বাজনা হয়, মাইক বাজে। প্রায়ই মাইক্রোবাসসহ এ জাতীয় গাড়ি ভেতরে ঢোকে, কেউ মোটরসাইকেলও ঢোকে। দিনরাত সবসময়ই এ ধরনের মানুষের আসা-যাওয়া করেন।

অন্যদিকে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার ঘটনায় শোকাহত নেতাকর্মী ও স্বজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা। বৃহস্পতিবার কালীগঞ্জ শহরে তার বাড়ির সামনে ভিড় করেন নেতাকর্মীরা। তারা জানার চেষ্টা করছেন, কবে নাগাদ এমপির মরদেহ পাওয়া যাবে, কবেই বা হত্যার প্রকৃত অপরাধীরা আইনের আওতায় আসবে। এমনই নানা প্রশ্ন নিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করছেন। তবে প্রথমদিনের তুলনায় নেতাকর্মী ও অন্যদের উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম।

এমপি আনার এলাকায় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। যে কেউ বিপদে পড়লে ছুটে যেতেন তিনি। দিতেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে। তার কাছে আসতে নির্বাচনী এলাকার কাউকেই অনুমতি নিতে হয় না।

সকালে এমপির মৃত্যুর খবরে তার বাড়ির সামনে এসে সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে কাঁদছিলেন খামারাইল গ্রামের গৃহিণী ফরিদা বেগম। সেসময় তিনি বলছিলেন, আমার ছেলে যখন পেটে ছিল তখন টাকার অভাবে সিজার করাতে পারছিলাম না। খুবই অসুস্থ ছিলাম। তখন খবর পেয়ে এমপি নিজে টাকা দিয়ে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। পরে টাকাও দিয়েছেন বাড়িতে ঘর করার জন্য। আমাদের এমন ভালো এমপিকে কেন মারা হলো, এর বিচার চাই।

এদিকে ৫ কোটি টাকার বিনিময়ে এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনাকারী ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বাসিন্দা ও আমেরিকার নাগরিক আক্তারুজ্জামান শাহীনসহ হত্যার পেছনে জড়িতদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন রাজনৈতিক সহকর্মীরা।

কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনিছুর রহমান মিঠু মালিথা বলেন, আমরা এমপি হত্যার বিচার চাই। শুধু শাহীনের দ্বারা হয়তো এমনটি হয়নি। এর পেছনে আরও অনেকেই জড়িত আছে, তাদের খুঁজে বের করুক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি তরিকুল ইসলাম তুহিন বলেন, এমপির মরদেহ টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। দেখলাম, জানলাম ৬ জন ধরা পড়েছে। এদের আড়ালে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। যে যাওয়ার সে চলে গেছে, কিন্তু আমাদের প্রিয় নেতা আনারের মরদেহটা শেষবারের মতো দেখতে চাই।

আব্দুল্লাহ আল মাসুদ/এমএএইচ/এমআরএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।