এমভি আবদুল্লাহর ফায়ারম্যান শাকিল
‘আমরা নামাজ পড়ার সময় তারা চারপাশে অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিতো’
বৃদ্ধ শামসুল হকের সঙ্গে দেখা হতেই মৃদু হেসে কুশল বিনিময় করলেন। আগের মতো কপালে কোনো চিন্তার ভাঁজ নেই। দেখে মনে হচ্ছে তিনি এখন অনেক খুশি। অথচ ছেলে জলদস্যুদের কাছে আটক হওয়ার পর যার সঙ্গে দেখা হয়েছে শুধু কেঁদেছেন। এখন আর কাঁদছেন না। কারণ আদরের ছোট ছেলে মুক্ত হয়ে এখন নীড়ে ফিরে এসেছেন।
একই চিত্র দেখা গেলো মা আনোয়ারার চোখে-মুখেও। ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই হেসে উত্তর দিলেন, ‘বাজারে গেছে, একটু পরে বাড়ি আসবে’।
প্রায় দেড় মাস যে পরিবারে কোনো আনন্দ ছিল না, সবসময় বিষাদের ছায়া আর মা-বাবার কান্না শোনা যেতো; এখন সেই বাড়ির চিত্র একেবারে ভিন্ন। এমন চিত্র দেখা গেছে সোমালিয়ায় জলদস্যুদের বন্দির কবল থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফেরা চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার কয়লা এলাকার মোশারফ হোসেন শাকিলের পরিবারে। শুধু তার পরিবারই নয়, শাকিলকে নতুন করে ফিরে পেয়ে এলাকার সবাই খুশি।
শাকিল উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের কয়লা পশ্চিম সোনাই গ্রামের শামসুল হক ও আনোয়ারা বেগমের ছোট ছেলে।
জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর ফায়ারম্যান মোশারফ হোসেন শাকিল মঙ্গলবার (১৪ মে) বাড়ি ফিরেছেন। চট্টগ্রামে জাহাজ থেকে নেমেই বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরেন। তাকে দেখতে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ভিড় করেন।
দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা স্মরণ করে মোশারফ হোসেন শাকিল জাগো নিউজকে বলেন, ‘সোমালিয়ান দস্যুদের কাছে ৩৩ দিন জিম্মি ছিলাম। প্রথম জিম্মি হওয়ার পর সবাই খুব ভয় পেয়েছিলাম। জীবিত বাড়ি ফেরার আসাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। প্রতিটি মিনিট মা-বাবা, ভাই-বোনের কথা মনে পড়তো। রাতে ঘুম হয়নি। উদ্বেগ ও আতঙ্কে কেটেছে কয়েকদিন।’
তিনি বলেন, ‘জলদস্যুরা আসতে দেখে সতর্ক অ্যালার্ম বাজানো হয়, সবাই সতর্ক ছিল। কিন্তু দস্যুদের সঙ্গে মোকাবিলা করার সাহস কারও ছিল না। প্রথমে দস্যুরা আমাদের জাহাজে প্রবেশ করে সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে একটি রুমে নিয়ে যায়। প্রথমে বাড়িতে কথা বলার জন্য মোবাইলফোন দিলেও কয়েক ঘণ্টা পর তা কেড়ে নেয়। ৩-৪ দিন দস্যুরা সবাই একই রুমে অবস্থান করেছি। কিন্তু থাকা ও খাওয়া খুবই কষ্টকর ছিল।’
‘আমরা রোজা রাখতাম। তখন রমজান মাস ছিল। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে ইফতার ও সেহেরি খেতে হবে। তখন তারা একটু নমনীয় হয়। সুযোগ দেওয়া হয় আমাদেরকে নামাজ আদায় করার ও রোজা রাখার। একটাসময় দস্যুরা অন্য রুমে যাওয়ার অনুমতি দেয়। পরে দ্রুত তারা আমাদের মালিক কবির গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। আমাদের জানায়, আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করবো না। মুুক্তিপণ পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করেছি। তোমাদের মালিক সাড়া দিয়েছে। মালিকপক্ষ প্রতিদিন যোগাযোগ করতো, তাদের সঙ্গে কথা বলতো। ঈদের দিন তারা আমাদের নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়’, যোগ করেন জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়া ফায়ারম্যান শাকিল।
শাকিল বলেন, ‘আমরা নামাজ পড়ার সময় তারা চারপাশে অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিতো। প্রতি ৩-৪ দিন পর পর তাদের সদস্যরা পরিবর্তন হতো। তবে প্রত্যকে অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ নিয়ে আসতো। মুক্তিপণ পাওয়ার পর তারা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।’
সপ্তাহে একবার সবাইকে পরিবারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়া হতো জানিয়ে ফায়ারম্যান শাকিল বলেন, ‘আমার এলাকায় মোবাইলের নেট (নেটওয়ার্ক) না থাকায় ৬-৭ বার কল দিয়েও কথা বলা সম্ভব হতো না। যখন সবাই কথা বলতো, আমি বলতে পারতাম না। তখন আরও বেশি খারাপ লাগতো।’
আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, এ যুগে এসে আমাদের এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, ভাবতে অবাক লাগে। আমাদের নতুন এমপির কাছে অনুরোধ থাকবে, তিনি এই এলাকায় যেন নেটওয়ার্ক টাওয়ার স্থাপনের উদ্যোগ নেন।
শাকিলের বড় ভাই আবু বক্কর বলেন, ‘কবির গ্রুপ থেকে সোমবার (১৩ মে) রাতে আমাকে ফোন করে জানায়, মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম বন্দরে শাকিল আসবে। তাকে রিসিভ করার জন্য আমি গেছি। ভাইকে দেখে ঈদের চেয়ে আনন্দ লাগছে। কারণ ঈদে আনন্দ করতে পারিনি। আতঙ্কে ও উদ্বেগের মধ্যে এতগুলো দিন অতিবাহিত করেছি। আমরা কবির গ্রুপ ও সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ।’
মিরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন বলেন, পরিবারের সদস্যদের মতো আমিও উৎকণ্ঠায় ছিলাম আদৌ সে জীবিত দেশে ফিরবে কি না। অবশেষে আল্লাহর অশেষ রহমত ও সংশ্লিষ্ট সবার প্রাণপণ চেষ্টায় ফিরে এসেছেন।
২০১৮ সালে কবির গ্রুপের মালিকানাধীন এমভি আব্দুল্লাহতে যোগ দেন শাকিল। এরপর থেকে তিনি এ জাহাজে রয়েছেন।
গত মার্চ ১২ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ান দস্যুরা। জাহাজে মিরসরাইয়ের মোশারফ হোসেন শাকিল ও আইনুল হক অভিসহ খানসহ মোট ২৩ নাবিক ছিলেন। পরে মুুক্তিপণের বিনিময়ে ৩৩ দিন পর দস্যুরা তাদের ছেড়ে দেয়। মঙ্গলবার (১৪ মে) বিকেলে চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ।
এম মাঈন উদ্দিন/এসআর/জেআইএম