নীরবে ১৬ বছরে পৌনে তিন লাখ তালবীজ রোপণ করেছেন চিত্ত দা
‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে/ সবগাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে ...।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতার মতো তালগাছ আকাশে উঁকি মারে বলেই বজ্রপাতের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক। বজ্রনিরোধক হিসেবে তাই তালগাছের পরিচিত রয়েছে। আর এই তালগাছের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়েছেন যশোরের অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী গ্রামের দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা চিত্তরঞ্জন দাস ওরফে চিত্ত দা। ২০০৮ সাল থেকে তিনি অভয়নগর ও ভবদহ অঞ্চলে রোপণ করে চলেছেন তালবীজ (আঁটি)। ১৬ বছরে রোপণ করেছেন পৌনে তিন লাখ তালবীজ। এর মধ্যে প্রায় এক লাখ তালগাছ ছায়া দিচ্ছে এই অঞ্চলে।
তালগাছপ্রেমী চিত্তরঞ্জন দাসের বয়স প্রায় ৬৭ বছর। যশোরের অভয়নগর উপজেলার সবাই তাকে চেনেন ‘তালগাছ প্রেমিক চিত্তরঞ্জন দাস’ ওরফে চিত্ত দা নামে। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সাত শতক জমিতে রয়েছে এক চালা টিন ও টালির তিনরুম বিশিষ্ট ঘর। স্ত্রী, বড় ছেলে সঞ্জয় দাসের পরিবার ও স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে রিতা দাসকে সঙ্গে নিয়ে বসবাস করেন তিনি। অভাবের কারণে ছোটছেলে রাজীব দাস থাকেন মামার বাড়ি ভারতে। ধোপাদী নতুন বাজার এলাকায় সরদারবাড়ির সামনে নারিকেল ও তালগাছের চেরাই করা বাতা বিক্রি করে সংসার চলে চিত্তরঞ্জন দাসের। বড়ছেলের কাঠের ব্যবসাও তেমন ভালো না।
চিত্তরঞ্জনের বয়স যখন তিন বছর, তখন তার মা মারা যান। ২০ বছর বয়সে বাবাও মারা যান। অভাবী কৃষক পরিবারের ছেলে হওয়ায় করতে পারেননি লেখাপড়া। বাবার শেখানো ও আমেরিকার এক বিজ্ঞানির বক্তব্য শুনে তালবীজ রোপণ শুরু করেন। মৃত্যুর আগে তার বাবা চিত্তরঞ্জনকে শিখিয়েছিলেন তালবীজ রোপণ করার পদ্ধতি। যে শিক্ষা এখন উপজেলাব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি।
চিত্তরঞ্জনের সাইকেলের হ্যান্ডেলে থাকে সারের বস্তা দিয়ে তৈরি একটি ব্যাগ। তার মধ্যে তালবীজ, গামছা, করাত, পানিভর্তি বোতল ও একটি দা। রাস্তা, পুকুর ও রেললাইনের পাশে বজ্রনিরোধক তালবীজ রোপণ করেন তিনি। রোপণের পর নিজ হাতে করেন পরিচর্যা। আর সারাবছর এই গাছের দেখভাল করেন। তিনি এসবই করেন স্বেচ্ছাশ্রমে।
তালগাছ প্রেমিক চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, ভাদ্রমাসে তাল পাকে। ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাস তিনি তালবীজ রোপণে পুরোটা সময় দিয়ে থাকেন। নিজের জমানো টাকা দিয়ে ভবদহ অঞ্চলের ৫০টি গ্রাম থেকে তালবীজ ক্রয় করেন তিনি। এছাড়া প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে বাসাবাড়ি এবং আবর্জনার স্তূপ ঘেঁটেও তালবীজ সংগ্রহ করেন। এরপর সেগুলো সংরক্ষণ করে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় গিয়ে তা রোপণ করেন।
প্রতিবছর ভাদ্র-আশ্বিন দু’মাসে গড়ে প্রায় ২০ হাজার তালবীজ রোপণ করেন। এ হিসাবে ২০০৮ সাল থেকে ১৬ বছরে দুই লাখ ৮৮ হাজার তালবীজ ও ৫৬ হাজার খেজুরবীজ রোপণ করেছেন তিনি। অভয়নগর উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও নওয়াপাড়া পৌর এলাকার ৪২টি ছোট-বড় রাস্তায় এসব বীজ রোপণ করেছেন তিনি। এছাড়া অসংখ্য পুকুর ও নদীর পাড়েও তালবীজ রোপণ করলেও যার হিসাব তিনি নিজেও রাখতে পারেননি। তবে সমাজের কিছু মানুষ তার রোপণ করা তালবীজের চারা উপড়ে ফেলে নষ্ট করেছেন। তালপাখা তৈরির জন্য প্রতিনিয়ত গাছের পাতা কাটছেন হাতপাখার ব্যবসায়ীরা। যা পরিবেশ ও গাছের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ভবদহ অঞ্চল দীর্ঘদিন জলাবদ্ধ থাকায় ওই সময়ে লক্ষাধিক তালগাছ মারা গেছে। এখনও প্রায় এক লাখ গাছ বেঁচে আছে বলে জানান চিত্তরঞ্জন দাস।
তিনি উল্লেখ করেন, এই কাজের জন্য মাঝে মধ্যে কিছু আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। সম্প্রতি অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম আবু নওশাদের পক্ষ থেকে খাদ্যপণ্যসহ কিছু উপহারসামগ্রী ও খেজুরবীজ ক্রয়ের জন্য নগদ ৫ হাজার টাকা পেয়েছেন।
চিত্তরঞ্জন আরও জানান, তিনি প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের রোপণ করা গাছ পরিচর্যা করতে সাইকেল চালিয়ে ছুটে যান বিভিন্ন গ্রামে। স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে গাছ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কোথাও তালবীজের খোঁজ পেলে ছুটে যান সেখানে। খুশি হয়ে বিনামূল্যে কেউ বীজ দিলে তা নিয়ে নেন, না হলে টাকা দিয়ে কিনে নেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজ ব্যবসার ফাঁকে তালবীজ সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন তিনি।
অভয়নগর উপজেলার সরখোলা গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন বলেন, বিলে কাজ শেষে ফেরার পথে তীব্র গরমে চিত্তরঞ্জনের রোপণ করা তালগাছের নিচে বসলে ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। উপজেলার অসংখ্য গ্রামে গিয়ে তিনি তালবীজ রোপণ করেছেন। তার এই উদ্যোগ যশোর জেলায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অতি সাধারণ এ মানুষটির প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের খেয়াল রাখা ও অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করা উচিৎ বলে মনে করেন এই কৃষক।
চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, ২০০৮ সালে রোপণ করা তালবীজ এখন ফলদ গাছে পরিণত হয়েছে। তবে কিছু গাছ স্থানীয় গ্রামবাসী নষ্ট করেছে। কিছু গাছ রাস্তা সংস্কারের সময় উপড়ে ফেলা হয়েছে। ভবদহ এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণে অনেক গাছ মারা গেছে। পরিবেশের জন্য তালগাছ জরুরি এবং বজ্রনিরোধক একটি গাছ। সকলের উচিৎ নিজ নিজ এলাকায় তাল ও খেজুরবীজ রোপণ করা।
তিনি আরও বলেন, যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন তালবীজ রোপণ করবো। তবে অভাবের সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। তাই সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকারি সহযোগিতা পেলে সুন্দরবনে গিয়ে নিজ হাতে দুই লাখ তালবীজ রোপণের ইচ্ছা তার।
অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম আবু নওশাদ বলেন, বৃক্ষপ্রেমিক চিত্তরঞ্জন দাস অভয়নগরসহ আশপাশের উপজেলায় অনেক বছর ধরে তালবীজ রোপণ করে চলেছেন। এই অঞ্চলজুড়ে তার লাগানো প্রচুর গাছ রয়েছে। এজন্য তাকে সরকারিভাবে সহযোগিতা করার ইচ্ছা আছে। এরইমধ্যে তার পরিবারের জন্য কিছু খাদ্যপণ্য ও উপহারসামগ্রী দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে অভয়নগরে তালবীজের পাশাপাশি খেজুরবীজ রোপণের প্রক্রিয়া চলছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বীজ ক্রয়ের জন্য তার হাতে অল্প কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে। সময় হলে তাকে সঙ্গে নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে বীজ রোপণ করা হবে।
এফএ/জিকেএস