৭ দশক ধরে কামার পেশায় মজিবর রহমান
প্রায় সাত দশক ধরে কামারশালার হাপর টেনে চলেছেন মজিবর রহমান। সেরা মানের কোদাল তৈরিতে সুখ্যাতি রয়েছে তার। তিনি জানান, এ পেশা তাকে দিয়েছে আর্থিক সচ্ছলতা, সামাজিক মর্যাদা ও খ্যাতি। দুর্দিন চলছে বলে যেখানে দেশের অনেক কামার পেশা ছাড়ছেন, সেখানে এ পেশাকে এখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছেন মজিবর রহমান।
৭৫ বছর বয়সী মজিবর রহমান সাত বছর বয়স থেকে কামারের কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার কুমিরগাড়ী গ্রামের বাসিন্দা। মৃত রোকন উদ্দিন সেখের ছেলে তিনি।
স্থানীয় কামারদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, এতো বছরের অভিজ্ঞ ও সক্রিয় কামার এলাকায় নেই। তার বাপ-দাদা এ পেশায় ছিলেন না। অথচ তিনি আজ থেকে ৬৮ বছর আগে ওস্তাদের কাছে এক যুগ ধরে কাজ শিখেছিলেন। সবচেয়ে বয়সী কামার হলেও তিনি নিজ হাতেই কাজ করেন। দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞ বলে তার কদর একটু বেশি।
মজিবর রহমানের দুঃখ—তিনি কোনো যোগ্য শিষ্য তৈরি করে যেতে পারলেন না। এর কারণ হিসেবে জানান, কাজ শিখতে সবার ধৈর্য কম। তিনি বলেন, এই ধৈর্যের অভাবে কেউ ভালো কাজ শিখতে পারেন না।
জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে মজিবর রহমান বলেন, ‘প্রথম যখন কাজ ধরলাম তখন একটি কাঁচি (মাঝারি সাইজ) তৈরিতে নিতাম দেড় টাকা। আর বড় কাঁচিতে (কাস্তে) দুই টাকা। এখন সেই দর বাড়তে বাড়তে ১৮ ইঞ্চি কাঁচি এক হাজার, ২০ ইঞ্চিরটা ১৫০০ টাকা নেওয়া হয়। সবশেষ দুই হাজার টাকা মজুরিতে ২৪ ইঞ্চির কাঁচি বানিয়েছি।’
আরও পড়ুন:
প্রথমদিকে ১০ টাকা কেজি মজুরিতে কোদাল বানাতেন প্রবীণ এ কামার। সবশেষ ৩০০ টাকা কেজি মজুরিতে কোদাল বানিয়েছেন। তবে বয়সজনিত কারণে এখন আর কোদাল বানাচ্ছেন না।
‘এক ক্লাস (প্রথম শ্রেণি) লেখাপড়া করেছিলাম। এখন তা কাজে লাগছে। আমি এখন কোরআন-হাদিসের তরজমা পড়ি। ছেলেরা এ পেশায় কেউ আসেনি। তারা দেশের বাইরে থাকে। ভালো আয় করে। তারা কাজ করতে নিষেধ করে। তারপরও আমি এ কাজ করি শুধু পেশার টানে। আর্থিক কারণে এখন কাজ করতে হয় না। আমার আয় সংসারে লাগে না’, যোগ করেন মজিবর রহমান।
মজিবর রহমানের প্রতিবেশী মোক্তার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মজিবর রহমান ছোটবেলা থেকেই এ কাজ করেন। তিনি কোদাল বানানোর জন্য খুব নামকরা ছিলেন। আশপাশের ১০-২০ গ্রাম থেকে শুরু করে জেলার বাইরের লোক তাকে চিনতেন। এখন এলাকার মুরুব্বিরা আসেন তার কাছে। তিনি তাদের সঙ্গে গল্প-গুজব করে টুকিটাকি কাজ করেন।’
স্থানীয় যুবক গোলজার হোসেন স্বপন বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে দেখছি তিনি নামকরা কামার। কোদাল, কুড়াল, বঁটি, কাঁচি, খুন্তা, শাবল সব তৈরিতে তার সুনাম। তিনি এ বয়সেও তার পেশাটি ধরে রেখেছেন। এটা বিরাট ব্যাপার।’
গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান আলী বলেন, ‘কুমিরগাড়ী গ্রামের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে তার নাম। হাপর টানার শব্দে গমগম করে যে গ্রাম, তিনি হারিয়ে গেলে তো এখানে শূন্যতা নেমে আসবে।’
পাবনার বেড়া মনজুর কাদের মহিলা ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আশরাফ পিন্টু। তিনি একজন কবি ও গবেষক। আশরাফ পিন্টু জাগো নিউজকে বলেন, ‘কামার পেশা একটি আদি পেশা। এ পেশায় নতুন করে এখন আর কেউ আসতে চান না। জেলায় প্রতিবছর কামারের সংখ্যা কমছে। সেখানে এ পেশায় ৬৮ বছর এক নাগাড়ে কাজ করা গর্বের ব্যাপার।’
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) পাবনার শিল্পনগরী কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ বলেন, কামারের কাজ করে প্রতিদিন ভালো আয় করা সম্ভব। গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত বেকার যুবকরা এ কাজটি করতে পারেন। এক্ষেত্রে মজিবর রহমান একটি দৃষ্টান্ত।
এসআর/এএসএম