‘ভাত জুটলেই হয়, ঈদ নিয়ে চিন্তা নেই’
সবাই ঈদের আনন্দে মেতে উঠলেও লক্ষ্মীপুরের মানতা সম্প্রদায়ের (ভাসমান জেলে) মনে নেই কোনো খুশি। টানা ১ মাস ১০ দিন তারা মাছ শিকার করতে পারেননি। অনেকের ঘরে এখন পেটভরে ভাত খাওয়ার চালও নেই।
সদর উপজেলার চররমনী মোহন ইউনিয়নের মজুচৌধুরীরহাট এলাকায় রহমতখালী খালে বসবাসরত মানতা সম্প্রদায়ের কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলে তারা আক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেননি। এখানে সম্প্রদায়টির ১২০টি পরিবার রয়েছে। যাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫০০।
মজুচৌধুরীর হাট স্লুইচ গেইট এলাকায় গেলেই দেখা যাবে নদীতে ছোট ছোট ডিঙি নৌকা ভাসছে। তবে এটি শুধু নৌকা নয়, ভাসমান জেলেদের আবাস্থল। আবার উপার্জনেরও একমাত্র বাহন। এ নৌকা দিয়েই নদীতে তারা মাছ শিকারে যান। তবে কয়েকটি পরিবার রহমতখালী তীরবর্তী এলাকায় টিনশেড ঘর করে বসবাস করছে।
মানতা সম্প্রদায়ের লোকজন জানান, তাদের উপার্জনের একমাত্র উৎস্য হচ্ছে মেঘনা নদীতে মাছ শিকার। আর ওই মাছ বিক্রি করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। পরিবারের ছোট শিশুটিও এ পেশায় নিয়োজিত। শিক্ষার আলো নেই বললেই চলে তাদের মাঝে। আর অন্য কোনো কর্ম তারা জানেনও না।
কিন্তু জাটকা সংরক্ষণের লক্ষ্যে লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় মার্চ-এপ্রিল দুই মাস সকল প্রকার মাছ শিকার নিষিদ্ধ। এতে মানতাদের উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে তারা দিনাতিপাত করছেন।
এদিকে নদীতে নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে বৃহস্পতিবার পুরো দেশ ঈদ আনন্দে মেতে উঠেছে। কিন্তু উপার্জন না থাকায় মানতা সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে সেই আনন্দ নেই। কারণ ঘরে পর্যাপ্ত খাবার নেই বললেই চলে। ঋণ করে সংসার চালাতে হচ্ছে। আর নতুন জামা তাদের কাছে স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না।
বৃদ্ধ মারজাহান বেগম (৬০) বলেন, চার ছেলেসহ তার পরিবারে ৯ সদস্য। মাছ শিকার করেই সবার আহারের ব্যবস্থা করা হয়। ৫টি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন তিনি। মাছ শিকার বন্ধ, তাই আয় রোজগারও বন্ধ। কিন্তু ঋণের কিস্তি বন্ধ নেই। কিস্তির টাকা দিতে দেরি হলেও কথা শুনতে হয়। এজন্য মহাজনের কাছ থেকে ‘দাদন’ (আগাম অর্থ) নিয়েই কিস্তি এবং সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন। ঈদ মানে এখন শুধু একটি শব্দ তাদের জন্য। ভাত জুটলেই হয়, ঈদ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই তাদের। মাছ শিকার করতে পারলেই তারা ঈদের আনন্দে আনন্দিত হন।
ভাসমান জেলে ইউসুফ, রাকিব হোসেন ও সফিক মাঝি জানান, দুই মাস মাছ শিকার বন্ধ। এ সময়টা সবার খুবই কষ্টে কাটে। আয়-রোজগার বন্ধ থাকে। জন্মের পর একটু বড় হতেই পরিবারের সঙ্গে মাছ শিকারে হাত লাগাতে হয়। এটা ছাড়া তাদের অন্য কোনো কাজ জানাও নেই। নদীতে অভিযানের সময় ধারদেনা করে সংসার চলে। গাঙে (নদী) না গেলে খাবার জোটে না।
মানতা সম্প্রদায়ের দলনেতা সোহরাব মাঝি বলেন, মানতা সম্প্রদায়ের ১২০টি পরিবারে ৫ শতাধিক সদস্য রয়েছে। এদের মধ্যে দেড় শতাধিক শিশু। প্রত্যেক পরিবারের আয়ের একই অবস্থা। মেঘনা নদীতে দুই মাস মাছ ধরা বন্ধ। এতে এখানকার লোকজনের আয়-উপার্জনও বন্ধ। ধারদেনা করে সংসার চালাতেই কষ্ট হচ্ছে। তাই বেশিরভাগ পরিবারের ঈদের কোনো আনন্দ নেই। ছোট্ট শিশুদের ভাগ্যেও নতুন জামা-কাপড় জোটে না।
তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞাকালীন আমাদের মাত্র ৪০ জন জেলে ৮০ কেজি করে চাল পেয়েছে। ১০ জন জেলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ১০ কেজি করে চালের কার্ড পেয়েছে। বাকিরা কোনো সহায়তা পায়নি। এছাড়া চালের সঙ্গে নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক কিছু লাগে। তাই অর্থ সংকটে থাকা ভাসমান জেলেরা সংসার চালাতে ঋণগ্রস্ত হচ্ছে। ভাসমান জেলেদের প্রতি কারো কোনো নজরদারিও নেই।
এফএ/এএসএম