ব্যস্ততা বাড়লেও বাটিকের গ্রামে মূল্যবৃদ্ধির বাগড়া
কিছুদিন আগেও তেমন কাজ ছিল না। সবারই অবসর সময় কাটতো। এতে জীবনযাপন করাটাও বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে গরম পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ বাড়তে শুরু করেছে বাটিকের গ্রামে। সেইসঙ্গে রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে কাজের চাপ আরেকটু বেড়েছে শ্রমিকদের।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার দুপ্তারা ইউনিয়নের বান্টি গ্রামের বাটিক ব্যবসায়ী ও কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। ইউনিয়নের এই গ্রামটিকে সাধারণত সবাই বাটিকের গ্রাম হিসেবেই চিনে থাকে। এই গ্রামের প্রায় সকলেই বাটিকের সঙ্গে জড়িত।
গ্রামের চারদিকেই দেখা মিলবে রঙ-বেরঙের কাপড়। রাস্তা, বাড়ির উঠান, ভবনের ছাদ বা খোলা ময়দানে বাটিকের নকশা করা ওড়না, সালোয়ার, কামিজ, বিছানার চাদর ও বালিশের কভারের কাপড় শোভা পাচ্ছে। সবমিলিয়ে প্রায় ৪-৫শ পরিবার এই বাটিকের কাজ করে থাকে।
বাটিক কারিগর ফারুক বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে আমাদের কাজ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বর্তমানে আমাদের গ্রামের প্রায় সকলেই এখন বাটিক নিয়ে ব্যস্ত। এভাবে চললে হয়তো আমাদের ঈদটা পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোই কাটবে।
নূরজাহান ফেব্রিক্সের মালিক আলমগীর বলেন, ঈদের জন্য আগের তুলনায় কাজকর্ম বেড়েছে। কাজ বাড়লে আমরাও ভালো থাকি, আমাদের কারিগরাও ভালো থাকে।
অর্ডার নিয়ে বাটিকের রঙ করে থাকেন মো. ইয়াকুব। মালিকপক্ষ তাকে সাদা কাপড় দিয়ে থাকে। আর সেই সাদা কাপড়কে তিনি নানা রঙে সাজিয়ে বাটিকের কাজ করে সরবরাহ করেন। তার অধীনে ১৫-১৬ জন কাজ করে থাকে।
ইয়াকুব বলেন, ঈদের বাজার শুরু হয়েছে। এখন বাটিকের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। কিন্তু মাঝখানে অনেক করুণ ছিল। তবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে হয়তো তুলনামূলক বেচাকেনা কম হচ্ছে। কারণ সবকিছুরই দাম বৃদ্ধি। তারপরও চলে খাওয়ার মতো অবস্থা রয়েছে। কিছুদিন আগেও আমাদের কাজকর্ম প্রায় বন্ধ ছিল।
মূল্যবৃদ্ধির বাগড়া
বান্টি এলাকায় জায়গা ভাড়া করে বাটিকের কারখানা দিয়েছেন নূরজাহান ফেব্রিক্সের মালিক আলমগীর। কিন্তু তার মূল ব্যবসা হচ্ছে ঢাকায়। কাজের সুবিধার্থে তিনি সেখানে কারখানা দিয়েছেন। তার অধীনে ৩০-৩৫ জন কাজ করে থাকে।
আলমগীর বলেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে এখন তেমন লাভ হয় না। যে রঙ ৪০০-৫০০ টাকায় কিনতাম সেটা ৪-৫ হাজার টাকা হয়ে গেছে। এমনিভাবে বাটিকের সব আইটেমের দাম বাড়ছে। রঙের বাড়তি দামের কারণে আমাদের বেগ পেতে হয়। ঠিকমতো অর্ডার সরবরাহ করতে পারছি না। সেইসঙ্গে যে পরিমাণ খরচ হয় সে পরিমাণ লাভ হয় না।
আহাদ ডাইংয়ের মালিক আহাদ বলেন, আগে যে রঙ ৩০০ টাকা ছিল সেটা এখন বেড়ে ৫০০ টাকা হয়েছে। ৫০ কেজি সোডা ছিল ১৮০০ টাকা এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ৪৫০০ টাকা, একইভাবে মোম ৫০ কেজি ৭ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১৩ হাজার টাকা হয়েছে। এভাবে প্রত্যেকটি পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। যার কারণে বাটিকে লাভ করাটা দূরহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাজ বাড়ছে দাম কমছে
বাড়ির ভেতরে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে বাটিকের রঙ করছিলেন বৃদ্ধা আমেনা বেগম। তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। সংসারের কাজের ফাঁকে বাটিকের কাজ করে থাকি। আগে কাজের দাম ছিল। এখন কমে গেছে। আগে অল্প কাজ করে ভালো টাকা পাওয়া যেত। আর এখন সারাদিন কাজ করেও সেই টাকা পাওয়া যায় না।
ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে নিয়ে বাড়ির পাশের মাঠে রঙ দিচ্ছিলেন ২৫ বছর বয়সী নারী কুলসুম। তার স্বামী একজন রিকশাচালক। স্বামী রিকশা চালান আর তিনি বাসায় ছোট ছোটে ছেলেমেদের নিয়ে বাটিকে রঙ করে থাকেন। বিগত ১০-১২ বছর ধরেই এই বাটিকের কাজ করে আসছেন তিনি।
কুলসুম বলেন, আগের থেকে কাজ বাড়ছে কিন্তু দাম কমেছে। মালিক-মহাজনরা আমাদের কাজ প্রতি দাম কমিয়ে দিয়েছে। আগে যে রঙ করলে ১২ টাকা পেতাম সেটা এখন ১০ টাকা পাই। যেটা ১০ টাকা পাইতাম সেটা ৮ টাকা পাই। তারপরও সংসারের চাপে কাজ করতে হয়। আমার সঙ্গে আমার ছোট ছেলে-মেয়েরাও সহযোগিতা করে থাকে। তারা দুইজনই পড়ালেখা করে। পড়ালেখার ফাঁকে আমার কাজে সহযোগিতা করে।
দুপ্তারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নাজমুল হক জাগো নিউজকে বলেন, এটা তাদের নিজস্ব ব্যবসা। যারা এই ব্যবসা করে, সকলেই ভালো আছে। এটা বেশ লাভজনক। তারা যখনই বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেন আমরা তাদের সহযোগিতা করে থাকি। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করি।
এফএ/এএসএম