যানবাহনের চাপ অনুযায়ী প্রশস্ত নয় সড়ক, বাড়ছে জনভোগান্তি
• প্রধান সড়কগুলো প্রশস্ত হয়েছে ১ দশমিক ২২ থেকে সর্বোচ্চ ৪ ফুট পর্যন্ত
• অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সড়কে যোগ হয়েছে ১ কিমি
• সড়ক প্রশস্তকরণে ব্যয় ১ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা
বছর দু’য়েক আগে সিলেট সিটি করপোরেশন ছিল মাত্র ২৬ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটারের একটি নগরী। বর্তমানে আয়তন বেড়ে হয়েছে তিনগুণ, প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটার। ওয়ার্ড সংখ্যা বেড়ে ২৭ থেকে হয়েছে ৪২টি। জনসংখ্যা ১০ লাখ। একই সঙ্গে বেড়েছে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, যত্রতত্র পার্কিং, বছরজুড়ে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি ও যানজট। সংকট-অব্যবস্থাপনায় রাজধানী ঢাকার মতো সিলেট নগরবাসীকেও প্রতিদিনই বাসায় ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। অপরিকল্পিত নগরায়ণ নিয়ে জাগো নিউজের সিলেট জেলা প্রতিনিধি আহমেদ জামিলের ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথমটি।
কাগজে-কলমে সিলেটে নিবন্ধিত যানবাহন প্রায় দুই লাখ। অথচ সড়ক দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে অন্তত চার-পাঁচ লাখ যানবাহন। সব ধরনের যানবাহনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়লেও সে তুলনায় প্রশস্ত হচ্ছে না নগরীর সড়কগুলো। যেগুলো প্রশস্ত হচ্ছে সেগুলো আবার চলে যাচ্ছে দখলে। এসবের কোনো তদারকি নেই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে। তুলনামূলক অপ্রশস্ত এসব সড়কে পরিবহনের চাপ বেশি থাকায় বাড়ছে যানজট ও জনভোগান্তি।
সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) তথ্যমতে, গত ১৪ বছরে নগরীর প্রধান সড়কগুলোর দুই পাশ এক দশমিক ২২ ফুট থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ চার ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে নগরীর ৯৬৮ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে প্রশস্ত হয়েছে ৩৭৫ কিলোমিটার। বাকি সড়কগুলো এখনো ২০ থেকে ৩৫ ফুটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
২০০২ সালে ২৬ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে যাত্রা শুরু হয় সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক)। ২৭টি ওয়ার্ডের সিলেট সিটি করপোরেশনই ছিল দেশের সর্বকনিষ্ঠ। সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নগরীর আয়তন বাড়ানোর উদ্যোগ নেন। ২০১৫ সালের ২৩ জুন নগরীর বর্তমান আকারের প্রায় ছয়গুণ আয়তন বাড়ানোর একটি প্রস্তাব স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৯ আগস্ট সিসিকের আয়তন বাড়ানোর বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে জেলা প্রশাসন। ২০২১ সালের আগস্টে বর্ধিত এলাকাগুলোকে ওয়ার্ডে বিভক্ত করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এতে সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর ও টুলটিকর ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বরইকান্দি, কুচাই ও তেতলি ইউনিয়ন সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২০২১ সালের ৩১ আগস্ট সিসিকের আয়তন সম্প্রসারণের গেজেট হয়। ফলে ২৬ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার থেকে আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ৭৯ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটারে। একই সঙ্গে নতুন করে আরও ১৫টি ওয়ার্ড যোগ হয়। বর্তমানের সিসিকের ওয়ার্ড সংখ্যা ৪২টি। ৭৯ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের হলেও নগরীর মূল কর্মযজ্ঞ চলে আনুমানিক ২০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে।
পুণ্যভূমি সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, চৌহাট্টা ও আম্বরখানা এলাকা। নামিদামি বেশিরভাগ শপিংমল ও বিপণিবিতান গড়ে উঠেছে এসব এলাকায়। যে কারণে জিন্দাবাজার-বন্দরবাজারকেন্দ্রিক মানুষের চলাচলও বেশি ছিল। তবে সিসিকের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূলবিন্দুর পরিধিও বাড়ছে। বর্তমানে নগরীর মদিনা মার্কেট, টিলাগড়, এয়ারপোর্ট, হুমায়ন রশিদ চত্বর পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ফলে এসব এলাকায়ও বেড়েছে মানুষের চলাচল। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভাগীয় সরকারি দপ্তরগুলো নগরীর বাইরে স্থানান্তর হওয়ায় সেসব এলাকায়ও প্রতিনিয়ত মানুষের যাতায়াত রয়েছে। নগরজুড়ে মানুষের যাতায়াত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে যানবাহনের চলাচলও।
সিলেট নগরীতে গণপরিবহনের সংখ্যা হাতেগোনা হলেও ব্যাপক হারে বাড়ছে ব্যক্তিগত যানবাহন। যানবাহনের চাপে প্রতিনিয়ত সড়কে বাড়ছে যানজট। প্রধান সড়কগুলো ছাড়াও এখন পাড়া-মহল্লায় যানজটের কবলে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে।
সিলেট নগরীর দরগাহ মহল্লা এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী আব্দুস সোবহান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আশঙ্কাজনক হারে যানবাহন বাড়ছে। সে তুলনায় সড়ক অনেক চিকন। যানজট হলে ফুটপাত দিয়েও অনেক যান চলাচল করে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল চালকরা সড়কে জায়গা না পেলে ফুটপাতের ওপর দিয়ে চলাচল করেন। এতে আতঙ্ক নিয়ে চলাচল করতে হয়।’
আরও পড়ুন
- সিলেটে বন্ধের পথে ‘নগর এক্সপ্রেস’
- টানা বৃষ্টিতে জলমগ্ন সিলেট, দুর্ভোগে নগরবাসী
- সিলেট সিটি কর্পোরেশনের আয়তন বাড়িয়ে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
নগরীর কাজলশাহ এলাকার বাসিন্দা ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘রিকাবীবাজার থেকে ওসমানী মেডিকেল সড়কটি নগরীর অন্য সড়কের তুলনায় অনেক ছোট। কিন্তু এ সড়কে অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল করে। সন্ধ্যা হলেই প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে পড়তে হয়। এ দুর্ভোগ কমাতে হলে সড়ক আরও প্রশস্ত করতে হবে।’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, সিলেটে নিবন্ধনভুক্ত যানবাহন এক লাখ ৯৪ হাজারের বেশি। নিবন্ধনভুক্ত যানবাহনের চেয়ে দ্বিগুণ যান চলাচল করছে নগরজুড়ে। কিন্তু সে তুলনায় নগরে সড়কের পরিমাণ অপ্রতুল। বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেট নগরে ২৫ শতাংশ সড়ক থাকার কথা। কিন্তু তার অর্ধেকও নেই। নগরীর অধিকাংশ সড়ক এখনো সেই ৩৫ থেকে ৪০ ফুট প্রশস্তের। ওয়ার্ডের ভেতরের রাস্তাগুলো প্রশস্ত ২০ ফুট।
সিলেট সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, নগরীর পুরোনো আয়তনের অর্থাৎ, ২৬ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের হিসাবে এক হাজার ১৩ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে ৯৬৮ কিমি সড়ক সিটি করপোরেশনের অধীনে। বাকি ৪৫ কিলোমিটার সড়ক ও জনপথের অধীনে। নতুন বর্ধিত ১৫টি ওয়ার্ডের সড়কগুলো এখনো স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে। এসব ওয়ার্ডে কী পরিমাণ সড়ক রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
সিসিক সূত্র জানায়, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত সিটির অধীনে থাকা ৯৬৮ কিমি সড়কের মধ্যে ৩৭৫ কিমি সড়ক প্রশস্ত হয়েছে। এসব সড়কের দু’পাশ এক দশমিক ২২ ফুট থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪ ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত হয়েছে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে আরও এক কিমি মূল সড়কের সঙ্গে যোগ হয়েছে। সব মিলিয়ে সড়কের সঙ্গে যোগ হয়েছে ২২ দশমিক ৬০ একর জায়গা। গত ১৪ বছরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ সড়ক প্রশস্তকরণের কাজে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৯৬২ কোটি টাকা।
বন্দরবাজার-জিন্দাবাজার-চৌহাট্টা সড়ক ছিল ৪০ থেকে ৪৫ ফুট। এটি প্রশস্ত হয়ে বর্তমানে হয়েছে ৫৮ থেকে ৬০ ফুটে। একইভাবে আম্বরখানা-চৌহাট্টা সড়ক ৩৫-৩৬ ফুট থেকে বর্ধিত করে ৪২-৪৫ ফুট ও চৌহাট্টা-রিকাবীবাজার ৪০ ফুট থেকে বর্ধিত করে ৭৫-৮০ ফুট করা হয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রশস্ত করা হয়েছে। প্রধান সড়কগুলো দুই ফুট থেকে আট ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত করা হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই ছিল ৪০-৪৫ ফুটের।’
তিনি বলেন, ‘অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে প্রায় এক কিলোমিটার সড়ক মূল সড়কের সঙ্গে যোগ হয়েছে। সব মিলিয়ে গত ১৪ বছরে প্রায় ২২ দশমিক ৬০ একর জায়গা সড়কের সঙ্গে যোগ হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।’
স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ রাজন দাস বলেন, ‘সড়কের দুই পাশে চার ফুট করে প্রশস্ত করলে সেটার সঙ্গে গাড়ির সংখ্যার সমন্বয় হবে কি না এটা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন। আগে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করতে হবে আমাদের। ট্রাফিক কী হারে বাড়ছে সে তুলনায় সড়ক বর্ধিত করতে হবে।’
‘একটি শহরে বিভিন্ন জোন আলাদা থাকে। কিন্তু আমাদের সিলেটে কমার্শিয়াল এলাকায় স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল হচ্ছে। আবার আবাসিক এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। সিটি করপোরেশনের আইন অনুযায়ী বিভিন্ন জোন আলাদা করা হয়েছে। জোন অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিতে হবে। একটা শহরের রাস্তার পাশেই হাসপাতাল হচ্ছে কিন্তু পার্কিং নেই। এ বিষয়গুলোতে সিটি করপোরেশকে দৃষ্টি দিতে হবে এবং যারা ব্যবহার করছেন তাদেরও সচেতন থাকতে হবে।’
সড়ক ও জনপথ (সওজ) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নগরীর ভেতরের সড়কগুলো প্রশস্ত করা হয়নি, শুধু সংস্কার করা হয়েছে। তবে যেসব সড়ক প্রশস্ত করার সুযোগ রয়েছে সেসব এলাকার ৪৬ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করার জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এখনো অনুমোদন হয়নি।’
‘সিলেট নগরীর সোবহানীঘাট এলাকার সিলেট-তামাবিল সড়ক ও তেমুখী-বাদাঘাট সড়কে উন্নয়নমূলক কাজ চলমান। নতুন প্রকল্পের মধ্যে তেমুখী-বাদাঘাট সড়ক রয়েছে। অন্য সড়কে সংস্কারকাজ চলছে।’
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিলেটে যানবাহন অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ব্যাপকহারে বেড়েছে। সে তুলনায় নগরীর সড়কগুলো প্রশস্ত নয়। এটিও যানজটের অন্যতম একটি কারণ।’
তিনি বলেন, ‘অনেক সংকট রয়েছে। সিটি করপোরেশনকে আমরা বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা দিয়েছি। এসব সংকট নিয়েও আমরা যানজট নিরসনে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছি।’
এ বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘যানজট রোধে হকারদের পুনর্বাসন করা হয়েছে। সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ অবৈধ পার্কিং নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের নির্ধারিত স্থানে বসতে বলা হয়েছে। এ নিয়েও আমরা কাজ করছি।’
জেএএইচ/এএসএ/এএসএম