ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণে পেনশনের টাকায় লাইব্রেরি

মোবাশ্বির শ্রাবণ মোবাশ্বির শ্রাবণ , জেলা প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত: ০৪:৫৭ পিএম, ০৮ মার্চ ২০২৪

অনেকেরই অনেক রকম স্বপ্ন থাকে। কেউ স্বপ্ন দেখেন চাকরি করবেন। সেই চাকরি শেষে পেনশনের টাকা দিয়ে বাড়ি-গাড়ি করবেন। অথবা অন্য কোনো স্বপ্ন থাকলে সেটা পূরণ করবেন। কিন্তু কেউ যদি স্বপ্ন দেখেন পেনশনের টাকা দিয়ে আলিশান ফ্ল্যাট কিনে লাইব্রেরি গড়ে তুলেবেন, তাহলে সেটা হবে নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। যা সচরাচর হয়ে উঠে না।

সেই কাজটাই করেছেন নারায়ণগঞ্জের অমিতাভ চক্রবর্তী। যিনি শহরের এস এম মালেহ রোড এলাকার জয়নাল প্লাজায় একটি পুরো ফ্ল্যাট কিনেছেন লাইব্রেরি করার জন্য। সেই সঙ্গে পেনশনের প্রায় পুরো টাকা দিয়েই তিনি ভবনটির ১৪ তলায় একটি বিশাল লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেন।

যেখানে প্রায় দুই হাজারের অধিক বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। যার নাম দিয়েছেন বইপোকা গ্রন্থাগার। যে কেউ ইচ্ছা করলেই সেখানে গিয়ে বই পড়তে পারবেন। সকলের জন্যই লাইব্রেরি উন্মুক্ত। আবার কেউ যদি সারাদিন সেখানে থেকে বই পড়তে চান সেটাও পারবেন। কারণ সেখানে একটি শয়ন কক্ষও রাখা হয়েছে। পাশাপাশি রান্না করারও ব্যবস্থা রয়েছে।

ছোটবেলার স্বপ্নপূরণে পেনশনের টাকায় লাইব্রেরি

বই পড়ার আগ্রহ থেকেই লাইব্রেরি

অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, ছোটবেলা থেকেই পড়ার আগ্রহ ছিলো। বাড়িতে পড়ার একটা আবহ ছিলো। আমার বাবা চিত্তরঞ্জন কটন মিলে চাকরি করতেন। সেখানে একটা অফিসার্স ক্লাব ছিলো। সে ক্লাবের অধীনে একটা লাইব্রেরি ছিল। তখন বাড়ির সবাই বই পড়তো। তাদের দেখে আমারও বই পড়ার উৎসাহ হয়। সৃষ্টি হয় ব্যাপক আগ্রহ। সেই আগ্রহ থেকেই আমার বহু বইয়ের সংগ্রহশালা হয়। আর সেসব বইয়ের যথাযথ সংরক্ষণের জন্যই এই লাইব্রেরি গড়ে তুলেছি। যেখানে যে কেউ ইচ্ছা করলেই এসে বই পড়তে পারেন।

ছোটবেলার স্বপ্নপূরণে পেনশনের টাকায় লাইব্রেরি

ছাত্রজীবনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন

ছাত্রজীবন থেকেই একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতাম। এ স্বপ্ন কখনও ভেঙেছে কখনও গড়েছে। বিভিন্ন সময় বাসা বদল করতে গিয়ে বই হারিয়ে গেছে। বন্যায় অনেক বই নষ্ট হয়েছে। অনেকে বই নিয়েও গেছেন। তবে আগে অগোছালো থাকলেও এখন লাইব্রেরি করায় গুছিয়ে নিয়েছি। শুধু লাইব্রেরির জন্যই ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে। এখানে দুই হাজারের অধিক বই রয়েছে। আমার বন্ধু-বান্ধবরা বই পড়তে আসে। পাশাপাশি বিল্ডিংয়ে যারা থাকেন তারাও বই পড়তে আসেন। এই ভবনে ৫২ পরিবার থাকে। সবারই আসার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও আমাদের একটি সার্কেল আছে তারাও পড়ার জন্য বই নিয়ে যায়।

ছোটবেলার স্বপ্নপূরণে পেনশনের টাকায় লাইব্রেরি

বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না

পুরস্কারের আশায় আমি এই লাইব্রেরি গড়ে তুলিনি। কখনও পুরস্কারের আশা করিও না। মনের খোরাক টাকা পয়সা দিয়ে মেটানো যাবে না। বই পড়া এমন একটা নেশা একবার যাকে ধরে এটা ছাড়া যায় না। এটা ইচ্ছা করলেও ছাড়ানো যায় না। সৈয়দ মুজতবা আলী বলে গিয়েছেন বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়েছে এরকম রেকর্ড নেই।

পরিবার সহযোগিতা করলেও বাহিরে কটূকথা শুনতে হয়
আমাকে পরিবারের সবাই সহযোগিতা করে। অন্যথায় একা এ লাইব্রেরি গড়ে তুলতে পারতাম না। এটা প্রতিদিন পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা বেশ কঠিন কাজ। আমার স্ত্রী আছে, পুত্রবধূরা আছে, নাতি-নাতনিরা সকলেই এটার প্রতি মনযোগী। আমি একসময় ব্যাংকার ছিলাম। অগ্রণী ব্যাংকে জব করতাম। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। আমার দুই ছেলে তারা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আমি পেনশনের টাকা দিয়ে লাইব্রেরিটা গড়ে তুলেছি। এতে পরিবারের সদস্যরা কোনো দ্বিমত পোষণ করেনি। তারা সবসময় আমাকে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু বাইরে অনেক কটূকথা শুনতে হয় আমাকে। অনেকেই আমাকে পাগলও বলে থাকে। ইচ্ছা করলে যে ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়ে অনেক টাকা পাওয়া যায় সেখানে একটি লাইব্রেরি বানানো অবাক করার মতো বিষয় বটে। তবে তাদের কথায় আমি কষ্ট পাই না।

ছোটবেলার স্বপ্নপূরণে পেনশনের টাকায় লাইব্রেরি

ফেসবুকের মাধ্যমে অমিতাভ চক্রবর্তীর সঙ্গে পরিচয় হয় তপন রায়ের। যিনি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। বর্তমানে তিনি বই পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তিনি ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে এসেছেন অমিতাভের লাইব্রেরি দেখার জন্য। তিনি বলেন, আমার কাছেও বইয়ের সংগ্রহ আছে। কিন্তু আমি চিন্তা করলেও এটা করতে পারতাম না। আসলে বই পড়ার মজাই আলাদা। উনি এটা ধরে রেখেছেন। উনাকে দেখে যদি একজনও অনুপ্রাণিত হয় তাহলেও অনেক। আমি মনে করি উনার শ্রম স্বার্থক।

ছোটবেলার স্বপ্নপূরণে পেনশনের টাকায় লাইব্রেরি

অনুপ্রেরণা যোগাবে বইপোকা
নারায়ণগঞ্জ জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান দেবাশীষ ভদ্র জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি জেনেছি। উনার এই লাইব্রেরি গড়ে তুলার বিষয়টি বর্তমান সমাজে অনুপ্রেরণা যোগাবে। নিঃসন্দেহ এটা অনেক প্রশংসীয় কাজ। উনার প্রতি শুভকামনা রইলো। এ উদ্যোগ নেওয়ায় আমরা তাকে ধন্যবাদ জানাই।

মোবাশ্বির শ্রাবণ/এনআইবি/এএইচ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।