‘যখন ঝড়-তুফান আহে তখন বইয়া বইয়া ভিজি’

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি শরীয়তপুর
প্রকাশিত: ০৮:২০ পিএম, ০৩ মার্চ ২০২৪
রাস্তার পাশে ছাপরা ঘরে বসবাস রানু বেগমের। ছবি-জাগো নিউজ

‘আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও/রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও/বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি/একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি/’

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন তার ‘আসমানী’ কবিতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সমাজে বসবাস করা অর্থকষ্টে জর্জরিত চাল-চুলোহীন এক শ্রেণির মানুষের সংগ্রামী জীবনের চিত্র। কবিতার সেই আসমানীদের হয়তো রসুলপুরে গিয়ে বাস্তবে দেখা সম্ভব হবে না। তবে কলাগাছের ঝোপের আড়ালে কয়েক টুকরা ছেঁড়া পলিথিনে মোড়ানো ছাপরা ঘরে বসবাস করা রানু বেগম (৬৬) যেন আসমানীদের প্রতিচ্ছবিই বটে। যার দিন কাটে মানুষের সাহায্য আর সহযোগিতা নিয়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রানু বেগমের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ভূমখাড়া ইউনিয়নের পূর্ব নলতা এলাকায়। ৫০ বছর আগে তার বিয়ে হয় পদ্মা নদীর কোলঘেঁষা সাহেবের চর এলাকার হাকিম খানের সঙ্গে। একাধিকবার নদীভাঙনের শিকার হয়ে সবশেষ ১০ বছর আগে সহায়-সম্বল সব হারিয়ে স্বামী-সন্তানদের সঙ্গে চলে যান রাজধানী ঢাকায়। সেখানে তার সন্তানরা কেউ রিকশার চালিয়ে কেউবা দিনমজুরের কাজ করে নিজেদের সংসার চালানো শুরু করেন। তবে সেই সংসারে বেশিদিন জায়গা হয়নি রানু বেগমের। অর্থ কষ্টের সংসারে সন্তানের কাছে বোঝা হয়ে চার বছর আগে ফিরে আসতে হয় বাবার বাড়িতে।

jagonews24

ভাইদের অবস্থা তেমন ভালো না হওয়ায় অন্যের বাড়িতে দুমুঠো খাবারের বিনিময়ে কাজ শুরু করেন রানু বেগম। তবে অসুস্থ শরীরে কাজ করতে না পারায় কয়েকদিন পর সেখান থেকেও ফিরে আসতে হয় তাকে। বর্তমানে বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া রাস্তার ধারে এক খণ্ড জমিতে পলিথিন আর কাপড় দিয়ে মোড়ানো খুপরি ঘর বানিয়ে বসবাস করছেন তিনি। যেখানে তার তার সঙ্গী একটি হারিকেন, একটি পাতিল, একটি কলস, একটি প্লেট আর কয়েকটি ছেড়া কাঁথা-কাপড়। রান্নার জন্য কোনো ঘর না থাকায় খোলা আকাশের নিচে রাস্তার ওপর চুলা বানিয়ে সেখানেই করেন রান্না। ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে সেই চুলা নষ্ট হওয়ার ভয়ে আগে থেকে তৈরি করে রাখতে হয় আরও কয়েকটি চুলা। এভাবেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন ষাটোর্ধ্ব এ নারী।

সরেজমিন দেখা যায়, রাস্তার পাশে খাল লাগোয়া একটি জায়গায় কয়েকটি বাঁশের খুঁটির সঙ্গে পলিথিন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে থাকার ঘর। পলিথিনের নিচে মাটিতে প্লাস্টিকের বস্তা বিছিয়ে করা হয়েছে শোবার জায়গা। একটু অদূরেই রাস্তার পাশে মাটির চুলা।

কথা হয় রানু বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘একসময় সুখে স্বামীর ঘর করেছি। নদীতে সব ভাইঙ্গা লইয়া গেলে পোলাপাইনের সঙ্গে ঢাকা চলে যাই। যখন দেখলাম সন্তানগোই পেট চলে না, তখন টিকতে না পাইরা বাপের বাড়ি চলে আসি। ভাইগো সামর্থ্য নাই যে আমার একটা ঘর বানিয়ে দিবো। পরে আমি নিজেই পলিথিন দিয়ে একটা ঘর বানাইয়া থাকতাছি।’

তিনি বলেন, ‘মানুষের বাড়িতে কাম কইরা চাইয়া চিন্তা খাই। যখন ঝড়-তুফান আহে তখন এই খুপরি ঘরে বইয়া বইয়া ভিজি। পাড়া-প্রতিবেশীরা কেউ দিলে খাইতে পারি, না দিলে না খাইয়া থাকি।’

নিজের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন রানু বেগম। তিনি বলেন, ‘অনেকদিন ধইরা আমি অসুস্থ তাই কাম করতেও পারি না। ভাইয়া একটু জায়গা দিছে, এইহানে আছি। তাগো অবস্থাও ভালো না। এই শীতে অনেক কষ্ট হইছে আমার। একজন আমারে একটা ছিঁড়া কাঁথা দিছিলো, তাই দিয়াই শীত পার করছি। সরকার থেকে আমাকে যদি একটু সাহায্য করতো তাহলে হয়তো একটু ভালো থাকতে পারতাম।’

jagonews24

রানু বেগমের ভাই নুর হক ছৈয়াল বলেন, ‘একসময় বইনে আমার কাছে থাকতো। পরে আমাগো কষ্ট দেইখা নিজেই রাস্তার ধারে খুপরি ঘর বানাইয়া থাকে। অনেক কষ্টে থাকে। মাঝেমধ্যে আমাকে ভাত দিলে সেই ভাত আমি অর্ধেক খাই, বাকি অর্ধেক বইনেরে দিয়া যাই। এখন সরকার যদি আমাগো মুখের দিকে চাইয়া একটা ঘর উঠায় দিতো, তাহলে ও খুব ভালোভাবে থাকতে পারতো।’

আমির হোসেন লাকুরিয়া নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘উনি রাস্তার মধ্যে একটা ভাঙা ঘরে থাকেন। কেউ যদি খাওন দেয় তাইলে খাইতে পারেন, না দিলে না খাইয়া থাকেন। ঝড়-তুফান আইলে প্লাস্টিক (পলিথিন) উড়াইয়া লইয়া যায়, আবার সেই প্লাস্টিক আইন্যা কোনোমতে ঠিকঠাক করে থাকে। আমরা চাই, সরকার থেকে তার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।’

রানু বেগমের অসহায়ত্বের কথা শুনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন নড়িয়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. পারভেজ।

তিনি বলেন, রানু বেগমের বিষয়টি আমি কিছুক্ষণ আগে গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তাকে সেখানে পাঠিয়েছি। খুব শিগগির তার জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হবে। বয়স্ক ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে।

 

বিধান মজুমদার অনি/এসআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।