৫ বছরেও হয়নি ব্যবস্থা

নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের ৪ কর্মচারীর অবৈধ বিদেশ ভ্রমণ

ইকবাল হোসেন মজনু ইকবাল হোসেন মজনু , নোয়াখালী
প্রকাশিত: ১০:৪৬ এএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের চার কর্মচারীর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণসহ স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি পাঁচ বছর আগে ঘটনার সত্যতা পেয়ে তাদের পাসপোর্ট জব্দসহ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে তদন্তের সুপারিশ করলেও অভিযুক্তরা এখনো রয়েছেন বহাল তবিয়তে।

অভিযুক্তরা হলেন, জেলা প্রশাসনের সংস্থাপন শাখার (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) অফিস সহকারী মো. আবদুল মুকিত, এস.এ (এস্টেট একুইজিশন) শাখার অফিস সহকারী আবদুর রহিম, এল.এ (ল্যান্ড একুইজিশন) শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মোস্তফা ও একই শাখার অফিস সহকারী মো. রিয়াজ উদ্দিন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নোয়াখালীর সাবেক জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌসের নেতৃত্বে ২০১৪-১৭ সাল পর্যন্ত অভিযুক্তরাসহ আরও কিছু অসাধু কর্মচারী সিন্ডিকেট গড়ে তুলে গণপূর্তের রেকর্ডীয় জমি খাস দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে বন্দোবস্ত, ঘুষ নিয়ে কর্মচারী বদলি, পদোন্নতি ও লোকজনকে চাকরি দিয়েছেন। এছাড়া চার কর্মচারী কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণ করে চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।

এনিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) দীপক চক্রবর্তী ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি বিষয়টি সরেজমিনে তদন্ত করেন এবং ওই বছরের ৩১ মার্চ বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে তিনি অভিযুক্ত চার কর্মচারীর অবৈধ বিদেশ ভ্রমণসহ বিপুল বিত্তবৈভব অবৈধভাবে অর্জনের প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন।

প্রতিবেদনের সুপারিশে তদন্ত কর্মকর্তা দীপক চক্রবর্তী বলেন, ‘অফিস সহকারী আবদুল মুকিত, আবদুর রহিম, হারাধন চন্দ্র পালকে আর্থিক সংশ্লেষমূলক রাজস্ব শাখা, উপজেলা ভূমি অফিস, ট্রেজারি শাখা, আরএম শাখায় এক বছরের কম সময়ান্তে ৩-৪ বার পদায়ন ও দীর্ঘ সময় থাকার সুযোগ করে দেওয়ায় অভিযোগে বর্ণিত কর্মচারী সিন্ডিকেটকে অবৈধ উপার্জনের সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত মর্মে প্রতীয়মাণ হয়।

এছাড়া আবদুল মুকিত ও আবদুর রহিম কর্তৃক যথাযথ কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি প্রমাণিত মর্মে প্রতীয়মাণ হয়। এ দুজনের বিপুল বিত্তবৈভব অবৈধভাবে অর্জনের বিষয়টি পাসপোর্ট জব্দ করাসহ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক বিস্তারিতভাবে তদন্ত করা প্রয়োজন।’

সুপারিশে আরও বলা হয়, ‘বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত অফিস সহকারী আবদুল মুকিত, আবদুর রহিম ও হারাধন চন্দ্র পালকে আর্থিক সংশ্লেষবিহীন শাখায় জরুরি ভিত্তিতে পদায়নের জন্য নোয়াখালী জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা প্রদান করা প্রয়োজন। এছাড়া কর্মচারীদের বদলি-পদায়নের ক্ষেত্রে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের জেলা ম্যাজিস্ট্রেসি পরীবীক্ষণ অধিশাখার ২০১৫ সালের ৮ জুলাই তারিখের ১৯১ নম্বর স্মারকের নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ না করার দায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌস এড়াতে পারেন না।’

দায়ের হওয়া প্রতিবেদনসহ বিষয়টি তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালক (তদন্ত) মো. মোস্তাফজুর রহমানকে চিঠি দিয়ে অবহিত করেন। তবে বিগত পাঁচ বছরেরও অনিয়মে জড়িত এসব কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উপরন্তু অসাধু এ সিন্ডিকেট দিন দিন আরও শক্তিশালী হয়ে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরকে নিজেদের কব্জায় রেখে অনিয়ম করে আসছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে জেলা প্রশাসনের সংস্থাপন শাখার সাবেক অফিস সহকারী মো. আবদুল মুকিত, এস.এ (এস্টেট একুইজিশন) শাখার বর্তমান অফিস সহকারী আবদুর রহিম, এল.এ (ল্যান্ড একুইজিশন) শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মোস্তফা ও একই শাখার অফিস সহকারী মো. রিয়াজ উদ্দিনের অবৈধ বিদেশ ভ্রমণের বিস্তারিত ইমিগ্রেশন তথ্য জাগো নিউজের হাতে এসেছে।

এতে দেখা যায়, সংস্থাপন শাখার সাবেক অফিস সহকারী মো. আবদুল মুকিত দুটি পাসপোর্ট (এই-৫৪২৪২০৭ ও বিপি- ০৬৫৪৪৭৪) ব্যবহার করে সাতবার অবৈধভাবে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। এরমধ্যে ২০১৩ সালের ২৭ জুন কোলকাতা গিয়ে ফেরেন ৫ জুলাই, ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট মালয়েশিয়া গিয়ে ফেরেন ৩০ আগস্ট, একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর মালয়েশিয়া গিয়ে ফেরেন ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি, ২০১৬ সালের ২৯ এপ্রিল সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ১ মে, একই বছরের ২৬ মে সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ২৯ মে, ওই বছরের ২০ অক্টোবর ব্যাংকক গিয়ে ফেরেন ২৩ অক্টোবর এবং ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ২৮ জুলাই।

এস.এ শাখার অফিস সহকারী আবদুর রহিম এই-৩৬৯৫৮৯২ নম্বরের পাসপোর্ট ব্যবহার করে গত ২০১৩ সালের ২৬ জুন কোলকাতা গিয়ে ফেরেন ৩ জুলাই, ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট মালয়েশিয়া গিয়ে ফেরেন ৩০ আগস্ট, একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর মালয়েশিয়া গিয়ে ফেরেন ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি, ২০১৬ সালের ২৯ এপ্রিল সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ১ মে, একই বছর ২৬ মে সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ২৮ মে, ওই বছরের ২১ জুলাই সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ২৫ জুলাই।

এল.এ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মোস্তফা এসি-৯৭৩০১৬৪ নম্বর পাসপোর্ট ব্যবহার করে মোট ৮ বার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। এরমধ্যে ২০১২ সালের ১৬ জুলাই কোলকাতা গিয়ে ফেরেন ১৯ জুলাই, একই বছরের ৫ ডিসেম্বর ব্যাংকক গিয়ে ফেরেন ১০ ডিসেম্বর, ২০১৩ সালের ২৬ জুন কোলকাতা গিয়ে ফেরেন ৫ জুলাই, ২০১৫ সালের ২৫ জুলাই ব্যাংকক গিয়ে ফেরেন ২৯ জুলাই, একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর মালয়েশিয়া গিয়ে ফেরেন ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি, ২০১৬ সালের ২৬ মে সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ২৯ মে, একই বছরের ২০ অক্টোবর ব্যাংকক গিয়ে ফেরেন ২৩ অক্টোবর এবং ২০১৭ সালের ১০ মার্চ ভারত গিয়ে ফেরেন ১৩ মার্চ।

এল.এ শাখার অফিস সহকারী মো. রিয়াজ উদ্দিন এই-২৪৪৭২৭২ নম্বর পাসপোর্ট ব্যবহার করে সাতবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। এরমধ্যে ২০১৩ সালের ২৬ জুন কোলকাতা গিয়ে ফেরেন ৫ জুলাই, ২০১৫ সালের ২৫ জুলাই ব্যাংকক গিয়ে ফেরেন ২৯ জুলাই, একই বছরের ২১ আগস্ট মালয়েশিয়া গিয়ে ফেরেন ৩০ আগস্ট, ২০১৬ সালের ২৯ এপ্রিল সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ১ মে, ২৬ মে সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ২৯ মে, ২১ জুলাই সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ২৫ জুলাই এবং ওই বছরের ২০ অক্টোবর ব্যাংকক গিয়ে ফেরেন ২৩ অক্টোবর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অফিস সহকারী আবদুল মুকিত নোয়াখালী সদর উপজেলার বিনোদপুর গ্রামের মো. আবদুল সোবহানের ছেলে। তিনি ১৯৮৩ সালের ৩ অক্টোবর এমএলএসএস পদে চাকরিতে যোগদান করে ১৯৮৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জারীকারক পদে এবং ২০০৩ সালের ১৬ নভেম্বর অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদোন্নতি পান। পরে তিনি নোয়াখালী ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়, ফেনীর পরশুরাম ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ নোয়াখালী সদর, বেগমগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ ও হাতিয়া ভূমি অফিসে চাকরি করেন। বিভিন্ন স্থানে তার অন্তত ২০ কোটি টাকার দৃশ্যমান সম্পদ থাকার অভিযোগ উঠলেও তিনি নির্বিঘ্নে অবসরে যান।

এস.এ শাখার অফিস সহকারী আবদুর রহিম নোয়াখালী সদর উপজেলার ফকিরপুর গ্রামের মো. আবদুর রশিদের ছেলে। তিনি ১৯৯৬ সালের ১ ডিসেম্বর এমএলএসএস পদে নোয়াখালী জেলার রাজস্ব প্রশাসনের এসএ শাখায় যোগদান করেন। পরে ২০০৩ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি বেগমগঞ্জ ও হাতিয়া ভূমি অফিসে চাকরি করেন। ২০০৩ সালের ১৬ নভেম্বর অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদোন্নতি পেয়ে তিনি জেলা প্রশাসকের সংস্থাপন শাখায় যোগদান করেন। পরে ২০০৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কার্যালয়ে, ২০০৭ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত কালেক্টরেট নেজারত শাখায়, ২০০৯ সালে এপ্রিল পর্যন্ত এস.এ শাখায়, ২০১৬ সালের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত আর.এম শাখায় এবং ২০১৬ সালের ১২ এপ্রিল থেকে অদ্যাবধি এস.এ শাখায় কর্মরত আছেন। তার কোটি কোটি টাকার বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ সম্পদের পাহাড়ের উৎস অদৃশ্য কারণে তদন্ত হয়নি। তার কাছে এখনো ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদেরকে ‘ভালো জায়গায়’ বদলির জন্য তদবীরের কোটি কোটি টাকা জমা আছে বলে অভিযোগ আছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে আবদুল মুকিত, আবদুর রহিম, মো. মোস্তফা ও মো. রিয়াজ উদ্দিনের সঙ্গে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা সবাই কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের বিষয়টি অস্বীকার করেন।

এছাড়া চার কর্মচারীর সবার দাবি, অবৈধভাবে বিদেশ ভ্রমণের জন্য তারা রাষ্ট্রের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন।

অন্যদিকে নোয়াখালীর সাবেক জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌসের মোবাইলে বারবার কল দিলেও তা বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে নোয়াখালীর বর্তমান জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, কর্মচারীদের এমন বিদেশ ভ্রমণ সম্পূর্ণ অবৈধ। তাদের এ বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। না নিয়ে থাকলে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এফএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।