ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনে অস্থিরতা
পোস্টার তৈরি করে কারাগারে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে নামে-বেনামে অপ্রপ্রচারের পোস্টার ছাপানোর অভিযোগে শামীম আশরাফ নামে এক গ্রাফিক্স ডিজাইনার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে গ্রেফতার করে আদালতে নির্দেশে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। এই ঘটনায় সিটি নির্বাচনে বিভিন্ন গ্রুপে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
এদিকে শামীম আশরাফকে গ্রেফতারের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ ও সমালোচনা করছেন নেটিজেনরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি নগরজুড়ে বেনামে পোস্টারিং করা হয়। এসব পোস্টারে সিটি করপোরেশন ও সদ্য সাবেক মেয়রকে হেয় করতে নানা বিভ্রান্তিকর, উসকানীমূলক তথ্য দেওয়া হয়। এমনটাই দাবি করে অপপ্রচারের অভিযোগ তোলেন সদ্য সাবেক মেয়র ইকরামুল হক টিটুপন্থী নেতাকর্মীরা। এসব পোস্টার সাঁটাতে গিয়ে সম্প্রতি গ্রেফতার হন তিন যুবক।
রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) রাত ১০টার দিকে নতুন করে আবারও আপত্তিকর পোস্টার ডিজাইন করার সময় শামীম আশরাফকে আটক করা হয়। পরে সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ৫৪ ধারায় আদালতে তোলা হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ নিয়ে নগরীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রকাশ্যে এসেছে।
গ্রেফতার শামীম আশরাফ একজন কবি এবং ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ। তাকে আটকের পর সদ্য সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক টিটু গ্রুপ, অন্যান্য মেয়র প্রার্থী ও বর্তমান এমপি মোহিত উর রহমান শান্ত গ্রুপের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কবি শামীম আশরাফকে গ্রেফতার করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন সাংস্কৃতিক কর্মীরা।
জানা গেছে, রোববার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আল আমিনসহ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা গিয়ে শামীম আশরাফকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন ও সাবেক মেয়র ইকরামুল হকের বিরুদ্ধে অপ্রচারমূলক পোস্টার তৈরি না করার অনুরোধ জানান। ওই সময় বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভও করেন আল আমিন। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে যান ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও মেয়রের বড় ভাই মো. আমিনুল হক শামীম। এর কিছুক্ষণ পরে পুলিশ শামীম আশরাফকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
পরদিন শামীম আশরাফকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে সোমবার বিকেলে ময়মনসিংহ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। পরে কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই মো. তাজুল ইসলাম আদালতের কাছে লিখিত আবেদন করেন। সেই আবেদনে উল্লেখ করা হয়, নগরীর ১ নম্বর মদনবাবু রোডের আমপট্টি মোড়ের গ্রাফিক্স ডিজাইনের দোকানে অবস্থান করে শামীম আশরাফ এলাকার আইনশৃংখলা অবনতি ঘটানোসহ বিভিন্ন উসকানি ও তথ্য বিভ্রান্তিমূলক কর্মকাণ্ড করে আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটনের চেষ্টায় লিপ্ত আছে মর্মে যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ রয়েছে। শামীম আশরাফ আমলযোগ্য অপরাদের সঙ্গে জড়িত আছে কিংবা অপরাধ করেছে মর্মে তাকে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। ঘটনার বিষয়ে পরবর্তী তদন্ত প্রতিবেদন না করা পর্যন্ত শামীম আশরাফকে জেলহাজতে রাখা একান্ত প্রয়োজন।
পরে আদালত মঙ্গলবার জামিনের শুনানির দিন ধার্য করে শামীমকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
কারাগারে নেওয়ার সময় প্রিজনভ্যান থেকে শামীম আশরাফ বলেন, ‘আমার সন্তানেরা আকাশ দেখতে পারে না, আমি সেই কথা বলি। আমার ব্রহ্মপুত্র শুকিয়ে যায়, আমি সেই কথা বলি। আমি আমার এই জনপদের মানুষের কথা বলি। আমি কবিতায়, উচ্চারণে কথা বলি সুন্দরের। এটাই হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ। এই অপরাধ নিয়েই আমি বাঁচতে চাই এবং সেই সুন্দরের কথাগুলো আমি অবিরত বলবো।’
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আল আমিন বলেন, কারো বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা থাকলে সেটি যৌক্তিকভাবে এবং প্রকাশ্যে করা যায়। কিন্তু বেনামি পোস্টার সাঁটানো বেআইনি। শামীম আশরাফ সিটি করপোরেশন এবং মেয়রের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচারের জন্য বেনামি পোস্টার দিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছেন। এমন অভিযোগের পর আমরা তার প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হাতেনাতে প্রমাণ পাই। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার করা উচিত নয়।
অপরদিকে এই ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান শান্ত। তিনি লিখেছেন, ‘শামীম আশরাফ একজন কবি, সাহিত্যমনা মানুষ। শহর ঘুরে ঘুরে সমাজের অসংগতি তুলে ধরেন প্রায়শই, আর মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেন। বিনোদনহীন আমাদের শহরে নিজের অর্থে অনেক সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম করেছেন মানুষের চিত্য বিনোদনের জন্য। সে ভুল করেছে না শুদ্ধ করেছে বিচার করবে আদালত। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।’
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইউসুফ আলী বলেন, সিটি করপোরেশন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। সিটি করপোরেশনের লোগো ব্যবহার করে যদি কেউ অপপ্রচার করে তাহলে আইনের দৃষ্টিতে অবশ্যই তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং যেহেতু সিটি করপোরেশনের লোগো ব্যবহার করে সে অপপ্রচার চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইন উদ্দিন বলেন, শামীম আমলযোগ্য অপরাধে জড়িত থাকতে পারে এমন সন্দেহ রয়েছে আমাদের। এটি তদন্ত শেষে বলা যাবে তিনি জড়িত আছে না কি নাই। মামলা হওয়ার যোগ্য কোনো অপরাধ ঘটালে আমরা ৫৪ ধারায় আটক করতে পারি। এরপর যদি তদন্তে প্রমাণিত হয় তার বিরুদ্ধে তখন মামলা হতে পারে।
এই ঘটনা নিয়ে সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সম্মেলন করেছেন দুই মেয়র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ফারমার্জ আল নূর রাজীব।
লিখিত বক্তব্যে এহতেশামুল আলম বলেন, রাতে আমিনুল হক শামীম এবং বেশ কিছু নেতাকর্মী শামীম আশরাফের ওপর চড়াও হন। সেখানে তারা গ্রাফিটির কম্পিউটারে ময়মনসিংহ নগরীর বেশ কিছু সমস্যা নিয়ে কিছু পোস্টারের ডিজাইন পান। এক পর্যায়ে পোস্টার তৈরির ব্যাপারে আমার নাম বলানোর চেষ্টা করা হয়। বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমি মোহিত-উর রহমান শান্তর পক্ষে কাজ করায় একজন প্রার্থীর বড় ভাই আমিনুল হক শামীম ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে আমার বিরুদ্ধে এই অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে সদ্য সাবেক মেয়র ইকরামুল টিটুর নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও তা বন্ধ দেখায়।
আগামী ৯ মার্চ ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। মূলত নির্বাচনকে সামনে রেখেই এই ঘটনার সূত্রপাত।
মঞ্জুরুল ইসলাম/এফএ/জেআইএম