১৫ টাকার এক গোলাপ আজ ৬০ টাকা
আজ পহেলা বসন্ত ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এ দিনটি বরণ করতে উন্মুখ থাকে তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষ। ফুলছাড়া এ দিনটি যেন একেবারেই বেমানান। একারণে অন্য সময়ের থেকে এ দিনটি এলে ফুলের চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ। এসময় ব্যস্ততা বেড়ে যায় ফুলচাষী ও ব্যবসায়ীদের। অতিরিক্ত চাহিদার কারণে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে ঝিনাইদহের দুইটি বড় ফুল বাজারে।
জেলার সবথেকে বড় ফুলের পাইকারী বাজার জেলা সদরের গান্না ও কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অন্য সময়ের থেকে দুই তিনগুণ বেশি দামে ফুল বিক্রি হচ্ছে। এসব বাজারে পাইকারি একটি গোলাপ আকার ভেদে ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। আর খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। এক থেকে দুই সপ্তাহ আগে একই গোলাপ বিক্রি হয়েছিলো ১৫ থেকে ২০ টাকা।
এছাড়া জারবেরা বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২৫ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগেও বিক্রি হয়েছিল ৫ থেকে ৮ টাকা। রজনীগন্ধার স্টিক বিক্রি হচ্ছে ৮ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছিল তিন থেকে পাঁচ টাকায়। একই সময়ে গাদা ফুল বিক্রি হয়েছে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা খোপা। দুই সপ্তাহ আগে এ খোপা বিক্রি হয়েছিলো ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়।
জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাঠে মাঠে ফুটে আছে লাল, হলুদ ও কমলা রঙের জারবেরা। ফুটে আছে রং বে-রঙের গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিয়াস ও গাদা ফুল। ফুলের রঙে স্বপ্ন রাঙাতে ব্যস্ত সময় পার করছে জেলার ফুলচাষিরা। প্রতিবছর বসন্ত বরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি ও ২৬ মার্চ এলেই এ জেলার ফুলচাষি ও ফুলকর্মীদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বিভিন্ন জাতীয় উৎসবে এ এলাকার উৎপাদিত ফুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফলে ফুলের বাড়তি চাহিদা মিটাতে ব্যস্ত সময় পার করে জেলার ফুলচাষীরা।
ব্যবসায়ী ও কৃষকরা বলছেন, ঝিনাইদহে গাদা ফুলের পরিমাণ সব থেকে বেশি। দেশের গাদা ফুলের মোট চাহিদার ৬৫ শতাংশ পূরণ করে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এ জেলার উৎপাদিত ফুল।
চলতি মৌসুমে ঝিনাইদহ জেলায় প্রায় ৪০০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়েছে। এরমধ্যে জেলা সদরে ৩৭ হেক্টর, কালীগঞ্জে ১৫০ হেক্টর, কোটচাঁদপুরে ৪৫ ও মহেশপুরে ১৫৯ জমিতে দেশি বিদেশি বিভিন্ন জাতের রং-বেরঙের ফুলের চাষ হয়েছে। ফুলের মধ্যে রয়েছে গোলাপ ১৬.২৬ হেক্টর, গাঁদা ১৩৮ হেক্টর, রজনীগন্ধা ৫৭.২৬ হেক্টর, জারবেরা ২১ হেক্টর, চন্দ্রমল্লিকা সাত হেক্টর ও আট হেক্টর জমিতে গ্ল্যাডিয়াস ফুলের চাষ হয়েছে।
সব থেকে বেশি ফুলের চাষ হয় জেলা সদরের গান্না ও কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নে। যে কারনে এ এলাকাটি অনেকের কাছে ফুলনগরী বলে পরিচিত। ১৯৯১ সালে জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের সৌখিন কৃষক ছব্দুল শেখ সর্বপ্রথম ফুল চাষ করেন। তিনি ওই বছর মাত্র ১৭ শতক জমিতে ফুল চাষ করে ৩৪ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করেন। এরপর থেকে এলাকায় বিভিন্ন জাতের ফুল চাষের বিস্তার শুরু হয়। বর্তমানে জেলার হাজার হাজার কৃষক ফুলচাষ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর গ্রামের ফুলচাষী টিপু সুলতান জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৭ সালে ৫৫ লাখ টাকা খরচ করে পাঁচ বিঘা জমিতে জারবেরা ফুলের চাষ করেছিলাম। বর্তমানে প্রায় ২০ বিঘা জমিতে আমার ফুল চাষ রয়েছে। এরমধ্যে গোলাপ রয়েছে পাঁচ বিঘার মত। বিদেশি ফুল জারবেরা কাটার পরেও এক সপ্তাহের বেশি সময় তাজা থাকে। রং আর বৈচিত্র্যে অনন্য জারবেরা ফুলের কোনো তুলনা নেই। এ ফুল চাষে এক বিঘাতে খরচ ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। তবে চার বছর একনাগাড়ে ফুল বিক্রি করা যায়। ফলে লাভ হয় তিন থেকে চার গুণ।
বালিয়াডাঙ্গা বাজার এবং ঝিনাইদহ সদর উপজেরা গান্নার ফুল বাজারে গিয়ে দেখা যায়, দুপুর থেকে শত শত কৃষক তাদের ক্ষেতের উৎপাদিত ফুল ভ্যান, স্কুটার ও ইঞ্জিন চালিত বিভিন্ন পরিবহনযোগে নিয়ে আসছেন। বেলা গড়ানোর সঙ্গে রং বে-রঙের ফুলে ফুলে ভরে যায় বাজার দুইটি।
কোটচাঁদপুর উপজেলার তালিনা গ্রামের কৃষক সনজিত দাস জানায়, আড়াই বিঘা জমিতে গাঁদা ফুলের চাষ করেছেন। এরই মধ্যে ৫০ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে বিক্রি করেছেন দেড় লক্ষ টাকার ফুল। এখনো অর্ধলাখ টাকার ফুল বিক্রি করা যাবে।
ওই গ্রামের কৃষাণী সীমা রানী জানান, সে প্রায় ১২ বছর ধরে ফুলের মালা তৈরি করার কাজ করছেন। গাঁদা ফুলের প্রতি খোপায় তার আয় হচ্ছে ১২ টাকা। এভাবে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়।
সদর উপজেলার গান্না বাজার ফুল চাষি ও ব্যবসায়ী সমিতির সাধারন সম্পাদক নজরুল ইসলাম জানান, এখন ফুলের বাজারে দাম বেশ ভালো রয়েছে। দাম ভালো পেলে ১১ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ও ২৬ মার্চ পর্যন্ত সদর, কালীগঞ্জ, মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর উপজেলার বিভিন্ন বাজার থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে ধারণা করছি।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা নূর-এ-নবী জানান, দাম ভালো পেতে ক্ষেত থেকে তোলার পর ফুল সতেজ রাখা জরুরি। কারণ গ্রাহক পর্যন্ত পৌছাতে অনেকটা সময় লেগে যায়। এ জন্য জারবেরা ক্ষেত থেকে কাটার সঙ্গে সঙ্গে পানির ভিতরে রাখতে হবে। গোলাপের ক্ষেত্রেও পানির ভিতরে রেখে হালকা পানি স্প্রে করতে হবে। গাদা ফুলও তোলার পর খেয়াল রাখতে হবে যেন ফুলে কোনো আঘাত না লাগে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের উপ-পরিচালক আজগর আলী জাগো নিউজকে জানান, ঝিনাইদহের মাটি ও আবহাওয়া ফুলচাষের জন্য উপযোগী। ফুলচাষ এ অঞ্চলের আর্থ সামাজিক উন্নয়য়ে বিরাট ভূমিকা রাখছে।
ফুল পরিবহন ও সংরক্ষণ প্রশ্নে তিনি জানান, পদ্মা সেতু হওয়া খুব সহজে অল্প সময়ে ফুল ও কৃষি পণ্যবাহী গাড়ি ঢাকা চট্রগ্রাম পৌছে যাচ্ছে। এছাড়া ফুল সংরক্ষণের জন্য বালিয়াডাঙ্গা বাজারে ফুল এসেম্বলী সেডের সঙ্গে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক রুম করা হয়েছে। যেখানে ফুল ও ফলের বীজ সংরক্ষণ করা যাবে বলে যোগ করেন তিনি।
আব্দুল্লাহ আল মাসুদ/এনআইবি/এএসএম