দু’হাজার বছরের পুরোনো হতে পারে ধনপোতা ঢিবির প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি যশোর
প্রকাশিত: ১০:০০ এএম, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

যশোরের ধনপোতা ঢিবিতে পাওয়া প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন দু’হাজার বছরের পুরোনো হতে পারে। আর এই স্থাপনা সনাতন বা বৌদ্ধ ধর্মাবলীদের হতে পারে বলেও ধারণা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। প্রথম পর্যায়ের খনন শেষে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রাথমিক এ ধারণার কথা জানান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা ও বরিশালের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন। তবে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু নিয়ে গবেষণার পর পুরো রহস্য উন্মোচিত হবে বলেও জানান তিনি।

বুধবার (৩১ জানুয়ারি) প্রথম পর্যায়ের এই খনন শেষ হয়েছে। এই খননে প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়েছে এবং প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন পাওয়া গেছে। পরবর্তীতে আরও খননের পর বিস্তারিত বলা সম্ভব হবে উল্লেখ করেন লাভলী ইয়াসমিন।

এদিকে বুধবার উপজেলার খেদাপাড়া ইউনিয়নের ধনপোতা ঢিবিতে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের খননে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর উন্মুক্ত প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ ইয়াকুব আলী।

যশোরের মণিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া ইউনিয়নে এই বিরাট রাজার ধনপোতা বা গুপ্তধনের ঢিবির অবস্থান। এর আগে এই উপজেলার ভোজগাতি ইউনিয়নে সন্ধান মেলে দমদম পীরের ভিটার। যা লালমাই পাহাড়ের বৌদ্ধ বিহার সভ্যতার সমসাময়িক। এবার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খনন করছে বিরাট রাজার ধনপোতা বা গুপ্তধনের ঢিবি। ধনপোতা ঢিবিতে খননে প্রাপ্ত প্রায় দুই হাজার বছর আগের পোড়া মাটির টেরাকোটা বল, চুন রাখার পাত্র, কাঁচের চুরি, লৌহ জাতীয় শলাকা, নকশাকৃত ইটের সন্ধান মিলেছে।

বুধবার ধনপোতা ঢিবির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রদর্শনকালে আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন আরও জানান, প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর সঙ্গে মণিরামপুর উপজেলার দমদম পীরের ঢিবি, পার্শ্ববর্তী কেশবপুরের ভরত ভায়না, ডালিঝিরা ঢিবি ও খুলনার পাইকগাছার কপিলমুনি প্রত্নস্থানের মিল রয়েছে।

দু’হাজার বছরের পুরোনো হতে পারে ধনপোতা ঢিবির প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৬ সালে মণিরামপুরের দোনার এলাকায় দমদম পীরের ঢিবি খনন করা হয়। মূলত তখন খেদাপাড়া অঞ্চলের এ ধনপোতা ঢিবির সন্ধান মেলে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে খেদাপাড়া এলাকার বিরাট রাজার ধনপোতা এ ঢিবির কাজ শুরু হয়। খননের দ্বিতীয় দিনেই একটি দেওয়ালের সন্ধান মেলে। পরে আরও একটি দেওয়ালের সন্ধান পাওয়া যায়। দেওয়ালে দুই ধরনের ইট পাওয়া গেছে। একটি ইটের দৈর্ঘ্য ৩২ সেন্টিমিটার, প্রস্থ ১৬ ও উচ্চতা ৫ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার। অন্যটির দৈর্ঘ্য ৩৬ সেন্টিমিটার, প্রস্থ ২২ ও উচ্চতা ৬ সেন্টিমিটার। দেওয়ালের গাঁথুনি কাদার। দেওয়ালে চুনের জমাট বাঁধা রয়েছে। এছাড়া খননে মৃৎপাত্র, পাথরের টুকরো, বাটি, পশুর হাড় ও পেরেক পাওয়া গেছে।

স্থানীয়দের মাঝে জনশ্রুতি রয়েছে, স্বরুপ নদীর পাড়ে ধনপতি সওদাগার নামে এক প্রভাবশালীর বাড়ি ছিল। আবার অনেকেই মনে করেন এই ঢিবিগুলি ঐতিহাসিকযুগে প্রতাপশালী বিরাট রাজার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। মহাভারতের বিরাট অংশের কাহিনীতে পঞ্চপাণ্ডব যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব তাদের একমাত্র স্ত্রী দৌপদীকে নিয়ে এই বিরাট রাজার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। শকুনি মামা গান্ধার রাজ্যের রাজার চক্রান্তে পাশা খেলায় হেরে যাওয়ার শর্তানুযায়ী পঞ্চপাণ্ডব ও তাদের একমাত্র স্ত্রী দ্রৌপদীকে নিয়ে ১২ বছর বনবাসে ছিলেন। তারা স্বরুপ নদীর তীরে বিরাট রাজার বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। মহাভারতের বিরাট কাহিনীর অংশের সঙ্গে এটির মিল রয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিমত।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি মনোরঞ্জন বিশ্বাস বলেন, তার ঠাকুর দাদা কুঞ্জবিহারী বিশ্বাস এক সময় অসুস্থ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন। তাকে ঝোলায় করে কলকাতায় চিকিৎসা করতে নিয়ে যাওয়া হয়। রোগ নিরাময় না হওয়ায় তাকে বাড়িতে ফেরত আনা হয়। এক রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন, তাকে বাড়ির পাশে এক বাগানে প্রাচীন বৃক্ষের নীচে রেখে আসার কথা বলা হয়। তারা স্বপ্ন অনুযায়ী ওই বৃক্ষের নিচে তাকে রেখে আসা হয়। তখন ওই বনে বনশুয়োর, বাঘসহ নানা হিংস্র পশুর বাস ছিল। কিছু দিনের মধ্যে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। পরে সুস্থ হয়েও তিনি ওই বৃক্ষের নিচে বসবাস করতে থাকেন এবং ধ্যান করতেন। এই বৃক্ষের গোড়ার অংশ এখনো ধনপোতা ঢিবির পশ্চিমে খেদাপাড়া বাজার সংলগ্ন বৈদ্যনাথ ধামে রয়েছে। মহাভারতে শিব আশ্রিত যে গাছের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার সঙ্গে এই প্রাচীন বৃক্ষের অবশিষ্টাংশের মিল খুঁজে পান স্থানীয়রা। বর্তমানে বৈদ্যনাথ ধামের এই প্রাচীন বৃক্ষের গোড়ার অংশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজা-অর্চনা করে থাকেন।

এছাড়া ধনপোতা ঢিবির পাশের বিল খুঁড়লেই প্রাচীন নৌকার অংশবিশেষসহ নানা ধরনের জিনিসের সন্ধান পাওয়া যায়। এতে স্থানীয়রা মনে করেন এই বিল এক সময় নদী ছিল, যা মহাভারতে উল্লিখিত স্বরুপ নদী বলে মনে করা হয়। এই নদী এক সময় প্রবাহমান ছিল। আর এই নদীর তীরে ছিল বিরাট রাজার বাড়ি। যেখানে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন পঞ্চপাণ্ডব ও তাদের একমাত্র স্ত্রী দৌপদী।

দু’হাজার বছরের পুরোনো হতে পারে ধনপোতা ঢিবির প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন

ধনপোতা ঢিবি সংলগ্ন স্থানীয় বয়োবৃদ্ধ ছলেমান মিয়া বলেন, তিনি বাপ-দাদার কাছ থেকে শুনে আসছেন এখানে বিরাট রাজার বাড়ি ছিল। পাশাপাশি আরও দুইটি ঢিবি রয়েছে।

এদিকে ধনপোতা ঢিবিতে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের খননে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর উন্মুক্ত প্রদর্শনীর উদ্বোধনকালে যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ ইয়াকুব আলী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাটির নিচে পড়ে থাকা সম্পদ খুঁজে বের করতে নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। এতে করে হাজারো বছরের আগের প্রত্নতাত্ত্বিক নানা ধরনের বস্তু উন্মুক্ত হচ্ছে। দেশের আপামর জনসাধারণ প্রাগ-ঐতিহাসিকসহ শত শত বছরের নানা নিদর্শনের রহস্য সম্পর্কে জানতে পারছে।

বুধবার উপজেলার খেদাপাড়া ইউনিয়নের ধনপোতা ঢিবিতে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের খননে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর উন্মুক্ত প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

এর আগে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পৌঁছালে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা প্রধান অতিথিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। এরপর ধনপোতা ঢিবিতে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের খননে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু ঘুরে ঘুরে দেখেন তিনি।

মিলন রহমান/এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।