উদ্বোধনেই সীমাবদ্ধ খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্প
উদ্বোধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্প। এক যুগের বেশি সময় পার হলেও এই লাইনে চলাচল করেনি কোনো যাত্রীবাহী অথবা মালবাহী ট্রেন। গত বছরের ১ নভেম্বর প্রায় ৯০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই রেললাইনটি উদ্বোধনের বেশ আগে থেকেই প্রকল্পের কাজ ৯৯ ভাগ শেষ হওয়ার কথা বলা হলেও এখনও টেলিকমিউনিকেশন ও সিগন্যালিং সিস্টেম স্থাপনের কাজও শেষ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এমনকি স্লিপার স্থাপনের কাজও বাকি রয়েছে। দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ও অর্থের পরিমাণ বাড়লেও কবে নাগাদ ট্রেন চলবে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না কেউ।
এদিকে যথা সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় এবং ট্রেন চলাচল শুরু না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খুলনার একাধিক নাগরিক নেতা ও ব্যবসায়ী। তারা বলছেন, এই লাইনটি চালু হলে মোংলা বন্দর আরও বেশি সচল হবে এবং পণ্য আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। সেইসঙ্গে খুলনার মানুষের কর্মসংস্থানও বাড়বে।
গত বছরের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে ভার্চুয়ালি খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্প উদ্বোধন করেন। কিন্তু এরপর প্রায় তিন মাস পেরিয়ে গেলেও যাত্রী অথবা পণ্যবাহী কোনো ট্রেন চলাচল করেনি। উদ্বোধনের পর একটি পরীক্ষামূলক ট্রেন গেছে ফুলতলা থেকে মোংলা পর্যন্ত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, এই রেলপথে আটটি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। স্টেশনগুলো হলো- ফুলতলা রেলওয়ে স্টেশন, আড়ংঘাটা রেলওয়ে স্টেশন, মোহম্মদনগর রেলওয়ে স্টেশন, কাটাখালী রেলওয়ে স্টেশন, চুলকাটী রেলওয়ে স্টেশন, ভাগা রেলওয়ে স্টেশন, দিগরাজ রেলওয়ে স্টেশন ও মোংলা রেলওয়ে স্টেশন। তবে সেখানে এখনও কোনো আসবাবপত্র দেওয়া হয়নি। রেলস্টেশন ও রেলক্রসিংগুলোর জন্য নিযুক্ত করা হয়নি কোনো জনবল। ফলে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে স্টেশন ও নবনির্মিত ক্রসিংগুলোর ভবন।
নগরীর মোহাম্মদ নগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কাজ করছেন রেল শ্রমিকরা। ট্রলিতে করে লাইনের বিভিন্ন সরঞ্জাম বহন করতে দেখা যায় তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শ্রমিকরা বলেন, লাইন কবে চালু হবে তা বলা সম্ভব নয়। কারণ এখনও লাইনের অনেক কাজ বাকি রয়েছে। সিগন্যালিং হয়নি, টেলিফোন লাইনের কাজও হয়নি। স্লিপারের বর্ডার দেওয়ার কাজও চলছে। এই কাজ শেষ করতেও বেশ সময়ের প্রয়োজন।
মোহাম্মদনগর স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নির্মিত স্টেশন ভবন মেরামতের কাজ করছেন মিস্ত্রিরা। তবে স্টেশনে পাওয়া যায়নি দায়িত্বশীল কাউকে।
এদিকে একের পর এক সময় দিয়েও ট্রেন চলাচল শুরু না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ মুহা. আশরাফ উজ জামান। তিনি বলেন, খুলনা-মোংলা রেললাইনটি খুলনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকল্পটি চালু হলে খুলনা থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর এবং দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দরের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। পণ্যের আমদানি-রপ্তানি বেড়ে যাবে। এতে খুলনার অর্থনীতির চাকা সচল হবে। কিন্তু ৯০ কিলোমিটারের এই প্রকল্পটি গত এক যুগেরও বেশি সময় পার করলেও সচল হয়নি। শুধু সময় আর অর্থের ব্যয় বেড়েছে।
খুলনার ব্যবসায়ী রিহ্যাব’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আজগর বিশ্বাস তারা বলেন, খুলনা-মোংলা রেললাইন কানেক্ট করে দিলে ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে বা নেপালের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা বাড়বে। এই অচল বন্দরকে আরও গতিশীল করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনা-মোংলা রেলওয়ে প্রকল্প করেছেন। কিন্তু এই প্রকল্প আজও শেষ হলো না। গত নভেম্বরে এটার উদ্বোধন হলেও এটা এখনও চালু হয়নি। যারা এর দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের দায়বদ্ধতা থাকতে হবে।
খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মফিদুল ইসলাম টুটুল বলেন, খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্প উদ্বোধন হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম দ্রুত রেললাইনটি চালু হবে। এটা চালু হলে এই অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটবে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটবে।
প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, আগামী মার্চ মাসে এই লাইনে ট্রেন চলাচল করবে। এই রেললাইনের মাধ্যমে ট্রানজিট সুবিধার আওতায় মোংলা বন্দর থেকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন সাশ্রয় ও সহজ হবে।
তিনি বলেন, খুলনার ফুলতলা রেলস্টেশন থেকে মোংলা বন্দরের জেটি পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। শুরুতে প্রকল্প মেয়াদ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদার।
২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় মোংলা-খুলনা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রথম দফায় প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮০১ টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি।
তবে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর সর্বশেষ ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়। সেই সঙ্গে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এরমধ্যে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লারসেন অ্যান্ড টুব্রো রূপসা নদীর ওপর রেলসেতুর নির্মাণকাজ করেছে। বাকি কাজ করেছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনাল।
প্রকল্পটির কাজ তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে রয়েছে রূপসা নদীর ওপর রেল সেতু নির্মাণ, মূল রেললাইন স্থাপন এবং টেলিকমিউনিকেশন ও সিগন্যালিং স্থাপন।
শুরু থেকেই প্রকল্পটি নানা ধরনের বাধার মুখে পড়ে। তিন বছর মেয়াদের কাজটির জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দিতেই সময় লেগে যায় দুই বছর। আর এ ধীরগতির কারণে তিন বছর মেয়াদের প্রকল্পটি ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬০ কোটি টাকায়। তবে তৃতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও ব্যয় বাড়েনি বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এফএ/জিকেএস