হার না মানা উল্লাস এখন বিসিএস ক্যাডার
আর দশটি শিশুর মতো স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেননি উল্লাস পাল (২৯)। মাতৃগর্ভ থেকে দুই হাত-পায়ের সমস্যা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন তিনি। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি তাকে। পরিবারের সহযোগিতা আর কঠিন অধ্যবসায় তাকে নিয়ে এসেছে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। অন্য সাধারণ প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন শরীয়তপুরের এই অদম্য শারীরিক প্রতিবন্ধী উল্লাস পাল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উল্লাস পালের বাড়ি জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের কার্তিকপুর এলাকায়। মৃৎশিল্পী উত্তম কুমার পাল আর আন্না রানীর তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড় তিনি। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় শিশু বয়স থেকেই স্বাভাবিকভাবে হাঁটা শেখা হয়ে ওঠেনি তার। জন্মগতভাবে দুই হাত ও দুই পা বাঁকা হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় হাটা শুরু করেন উল্লাস। এরপর বাবা-মা তাকে সুস্থ করতে ভারতে নিয়ে চিকিৎসার করান। সেখানে তার ডান পায়ে একটি অস্ত্রোপচার করা হলে ধীরে ধীরে নিজে নিজেই হাঁটা শুরু করেন। তবে সেটা স্বাভাবিক হাঁটাচলা ছিল না।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই ভীষণ মেধাবী ছিলেন উল্লাস। তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ১৯৯৯ সালে বাড়ির পাশের কার্তিকপুর পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। বর্ষার দিনে স্কুলে যাতায়াত ভীষণ কষ্ট হওয়ায় বাবা উত্তম পাল সবসময় ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসতেন। উল্লাস লিখতেনও বাম হাতে। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলা দারুণ পছন্দ করতেন। সহপাঠীরা যখন খেলতো তখন অনেকটাই দর্শকের চোখে তাকিয়ে থাকতেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকায় নিজে খেলার সুযোগ তেমন পাননি।
প্রাথমিক স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে ২০১০ সালে কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন উল্লাস। এরপর চলে আসেন ঢাকায়। ভীষণ ইচ্ছে ছিলো পড়বেন ঢাকা কলেজে, কিন্তু সেখানে বাধ সাধলো শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। অবশেষে ঢাকা নর্দান কলেজ থেকে ২০১২ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ভর্তি হন স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৬ সালে ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে বিবিএ এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন।
এরপর উল্লাসের জীবনে শুরু হয় চাকরির দৌড়ঝাঁপ। একে একে অনেকগুলো চাকরির পরীক্ষাও দেন। পাশাপাশি প্রস্তুতি নিতে থাকেন বিসিএস পরীক্ষার। ৪০তম এবং ৪১তম বিসিএসেও মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। ৪০তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হলেও ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কোনো পদেই সুপারিশপ্রাপ্ত হননি। তবে ৪১তম বিসিএসে জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে সুপারিশ পান। সবশেষ ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। তবুও মনের ভেতর খানিক আক্ষেপ রয়েই গেছে তার, পছন্দের ক্যাডার প্রশাসন না পাওয়ায়। বর্তমানে উল্লাস পাল প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক নড়িয়া শাখার সিনিয়র অফিসার পদে কর্মরত।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে সাফল্যের আকাশছোঁয়ার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে উল্লাস পাল জাগো নিউজকে বলেছেন, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় সমাজের অনেকেই ঠাট্টা মশকরা করেছে। আবার অনেকেই ভীষণ ভালোবেসেছে। যারা আমাকে ছোটবেলা থেকে সঙ্গ দিয়েছে তারা এখনো আমার পাশে রয়েছে। আমার বাবা-মা আমার জন্য অনেক করেছেন। তাদের জন্যই হয়তো এতদূর আসতে পেরেছি। পড়াশোনায় অন্যদের চেয়ে ভালো ছিলাম, তাই শিক্ষকদের কাছ থেকেও ভালোবাসা পেয়েছি।
তিনি বলেন, একটা বিষয় সবসময় মাথায় ঘুরতো, আমি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী, তাই অন্যদের চাইতে পড়াশোনায় বেশি পরিশ্রম করতে হবে। আমি অনেকগুলো চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি, তবে ভাইভাতে গিয়ে কোনো এক অজানা কারণে বাদ পড়ে যেতাম। তারপরও দমে যাইনি কখনো, আরও বেশি পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি। যে কারণে আজ আমি বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। তবে ইচ্ছে ছিল প্রশাসন ক্যাডারে যাওয়ার। যার জন্য আমি এখনো পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি।
তার মতো যারা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের উদ্দেশে উল্লাস পাল বলেন, যারা শারীরিক বা মানসিকভাবে ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের পাশে থেকে পরিবারকে প্রথমে সাপোর্ট দিতে হবে। নিজেকে ঘরের কোণে না রেখে প্রকাশ্যে আনতে হবে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য পড়াশোনা করতে হবে।
তার এমন অভাবনীয় সাফল্যে খুশি পরিবার ও স্কুলের শিক্ষকরা। উল্লাস পালের মা আন্না রানী পাল জাগো নিউজকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই আর পাঁচটা ছেলের মতো বেড়ে উঠেনি উল্লাস। আমাদের ভীষণ কষ্ট হয়েছে ওকে বড় করতে। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় ভীষণ মনোযোগী ছিল। আজ আমরা ওকে নিয়ে গর্বিত।
বাবা উত্তম কুমার পাল বলেন, আমাদের উল্লাস জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী। আমরা চেষ্টা করেছি ডাক্তার দেখিয়ে ওকে সুস্থ করে তুলতে। পরিবারে কেউ ওকে কখনো প্রতিবন্ধী হিসেবে দেখিনি। ছোটবেলা থেকে বিশেষভাবে যত্ন করে বড় করেছি। আমাদের চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখিনি। ও নিজেও অনেক পরিশ্রম করেছে। ওর কষ্ট সার্থক হয়েছে। আমরা ওকে নিয়ে অনেক বেশি গর্বিত ও আনন্দিত।
উল্লাসের প্রতিবেশী রূপক পাল বলেন, একজন মানুষ প্রতিবন্ধী হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেই সে সমাজের বোঝা নয়, তার দৃষ্টান্ত আমাদের উল্লাস। ও পড়াশোনা করে আজ বিসিএস ক্যাডার হয়েছে, এটা সত্যিই আমাদের সবার গর্ব। আমরা চাই, ওর প্রশাসন ক্যাডার হওয়ার ইচ্ছেটাও পূরণ হোক।
কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক তুষার কান্তি গাইন জাগো নিউজকে বলেন, উল্লাস পাল আমাদের ছাত্র। সে এই উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ভালো ফলাফল নিয়ে মাধ্যমিক পাস করেছে। তবে অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়েও সে একটু ব্যতিক্রম। শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় ঠিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারতো না। বাম হাত দিয়ে লেখালেখি করতো। কিন্তু ভীষণ রকমের মেধাবী ছিল। এখন বিসিএস ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। আমরা শিক্ষকরা ওকে নিয়ে গর্ববোধ করি।
বিধান মজুমদার অনি/এমকেআর/জিকেএস