লাভবার্ডসের ব্রিডিং ফার্মে প্রতিবন্ধী আরিফুজ্জামানের সফলতা
সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে ৪৮টি লাভবার্ডসের খাঁচা। খাঁচাগুলোর সম্মুখভাগে যুক্ত করা হয়েছে খড়কুটোযুক্ত ছোট ছোট কাঠের বাক্স। প্রতিটি বাক্সের মধ্যে এখন চলছে লাভবার্ডসগুলোর ডিমে তা দেওয়ার প্রস্তুতি। ডিম ফোটার ১৫ দিনের মাথায় এসব খাঁচা থেকে বের করে আনা হবে বিভিন্ন প্রজাতির ফুটফুটে লাভবার্ডসের ছানা।
শরীয়তপুরে লাভবার্ডসের এমন একটি ব্রিডিং ফার্ম তৈরি করে সফলতার মুখ দেখেছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী ইঞ্জিনিয়ার আরিফুজ্জামান খান (৪০)। শুধু তাই নয় এই খামারের মাধ্যমে তৈরি করেছেন বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান।
নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর ইউনিয়নের নরকলিকাতা এলাকার সুলতান আহম্মেহ খান ও আমেনা খাতুন দম্পতির ছেলে আরিফুজ্জামান খান। তার বয়স যখন ৬ মাস তখন পলিও রোগে বাম পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবারের সাহায্য নিয়েই হাঁটতে হতো তাকে। স্কুলে যাতায়াতে সুবিধার জন্য ছোট বোনের সঙ্গে একই ক্লাসে ভর্তি হতে হয় তাকে। বড় হয়ে যখন বুঝতে পারলেন তার এই সমস্যা পরিবারে ওপর প্রভাব ফেলবে তখন আর কারো বোঝা হতে চাননি। নিজেই কিছু করার চেষ্টা করলেন। গ্রাম থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে প্রথমে ভর্তি হন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। এরপর স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনার পাঠ চুকান।
ঢাকায় পড়াশোনার দিনগুলো ছিল তার জন্য ভীষণ চ্যালেঞ্জের। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় বাস থেকে নামতে গিয়ে বেশ কয়েকবার আহতও হয়েছেন। পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে প্রবেশ ছিল আরও চ্যালেঞ্জের। তবে দমে যাননি তিনি। চাকরি জীবনে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিজ কর্মদক্ষতার গুণে কয়েক মাসের মধ্যেই পেয়েছিলেন পদোন্নতি।
এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন চাকরি ছেড়ে নিজে কিছু করবেন। তাই ২০২১ সালে চাকরি ছেড়ে বাড়িতে চলে আসেন। এলাকায় ফিরে ইন্টেরিয়র ডিজাইন করার পাশাপাশি ৪৫ শতাংশ জমি ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন শৌখিন লাভবার্ডসের ব্রিডিং ফার্ম। ২ বছরের প্রচেষ্টার মাধ্যমে তার এই ফার্মে এখন ১৫ প্রজাতির লাভবার্ডসের ব্রিডিং করানো হয়। তার এই খামারের প্রতি জোড়া পাখির মূল্য প্রকারভেদে দেড় হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে তার খামারে ৪৮ জোড়া প্রাপ্তবয়স্কর পাশাপাশি অন্তত ৩০ জোড়া বিভিন্ন বয়সী লাভবার্ডস রয়েছে। তিনি এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু না করলেও কিছু কিছু সৌখিন পাখি প্রেমীদের কাছে লাভবার্ডসগুলো বিক্রি শুরু করছেন। কয়েক বছরের মধ্যে তার এই খামার থেকে লাখ টাকা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
সরেজমিনে তার লাভবার্ডসের খামারে গিয়ে দেখা যায়, পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত খামারটি। ৪৮টি খাঁচার ভেতর থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে হলুদ, সবুজ, নীলসহ বিভিন্ন রঙের মিশ্র লাভবার্ডস। খাঁচার সামনে ১০ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, ৮ ইঞ্চি প্রস্থ ও সাড়ে ৭ ইঞ্চি উচ্চতার কাঠের বাক্স বসানো হয়েছে। এই বাক্সগুলোর মধ্যে ৩৬টি পাখি ডিম পেড়েছে। কিছু পাখির ছানা আবার একত্রিত করে দুটি ছোট খাঁচার মধ্যে রাখা হয়েছে। এখান থেকে বাচ্চাদের খাবার খাওয়াচ্ছিলেন আরিফুজ্জামান খান।
আরিফুজ্জামান খান বলেন, ছোটবেলা থেকেই দেখেছি শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিরা নিজেদের সমাজের বোঝা মনে করেন। আমি বোঝা হতে চাইনি বলে পড়াশোনা করে চাকরি করেছি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, আমি নিজে যদি কিছু করতে পারি সেটা সবচেয়ে ভালো। তাই চাকরি বাদ দিয়ে আমি গ্রামে ফিরে বিল্ডিংয়ের ডিজাইন তৈরির পাশাপাশি ইন্টেরিয়র ডিজাইন শুরু করি। এর পাশাপাশি আমি লাভবার্ডসের ব্রিডিং ফার্ম ও বায়োফ্লক্স পদ্ধতিতে মাছের চাষ শুরু করি। আপাতত লাভবার্ডসের ব্রিডিং ফার্ম চালু রয়েছে। দীর্ঘ ২ বছর প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমি লাভবার্ডস থেকে ছানা পাওয়া শুরু করি। আমার খামারে আপাতত ২ জন লোক কাজ করছে। এই খামারটি ভবিষ্যতে আরও বড় করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি বলেন, বেকার যুবকরা যদি চাকরির আশায় বসে না থেকে আমার মতো এমন পাখির খামার তৈরি করতে পারে তাহলে তারা বেশ ভালো উপার্জন করতে পারবে।
খামারটি দেখাশোনা করা শাকিল হোসেন (২২) বলেন, আমি ভাইয়ের এখানে প্রথম থেকেই রয়েছি। তার সঙ্গে আমিও পাখিগুলোর যত্ন নেই। এখানে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির পাখি আছে। নানা রকমের লাভবার্ডসগুলো দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রব খান বলেন, আরিফ আমাদের এলাকার সন্তান। ও নিজে প্রতিবন্ধী হয়েও সুন্দর একটি খামার তৈরি করেছে। যা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমারো ইচ্ছা আছে এমন একটি পাখির খামার তৈরি করার।
ভোজেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা কাঞ্চন হোসেন বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যে সমাজের বোঝা নয় আরিফুজ্জামান তার দৃষ্টান্ত। তিনি সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার। এছাড়াও সমাজের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান করতে নিজেই গড়ে তুলেছেন সুন্দর একটি পাখির ও মাছের খামার। সেখানে কয়েকজন যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তার এই কাজকে আমরা স্যালুট জানাই। সবাই তার জন্য দোয়া রাখবেন।
এফএ/জিকেএস