লাভের স্বপ্নে মাঠে ৩৯ হাজার লবণ চাষি
কক্সবাজার-চট্টগ্রামে জমে উঠেছে লবণ উৎপাদন। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) মৌসুমে প্রায় সাড়ে ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিকটন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এবারে মাঠে নেমেছেন প্রায় ৩৯ হাজার ৪৮৭ লবণ চাষি। গত অর্থবছরে ভালো লাভ হওয়ায় এবার ব্যাপক উদ্দিপনায় চাষিরা ৬৬ হাজার ৪২৪ একর জমিতে লবণ চাষ করছেন। ইতোমধ্যে অনেক চাষী নতুন মৌসুমের কয়েক চালান লবণ তুলেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে নির্ধারিত সময়েই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে, ভয়ও কাজ করছে চাষিদের। মৌসুমের ফাঁকে যদি কোনো কারণে লবণ আমদানি হয়- তখন উৎপাদিত লবণের ন্যায্য দাম না পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনটি হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ খাত লবণ শিল্প।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, একটি মধ্যস্বত্বভোগী সরকারের উচ্চ পর্যায়কে ভুল বুঝিয়ে লবণ আমদানির আয়োজন করতে পারে। অথচ জেলার সাত ও চট্টগ্রামের দুই উপজেলায় লবণ চাষে পুরোদমে মাঠে নেমেছে প্রান্তিক চাষিরা। গত ৩০ অক্টোবর চলতি লবণ মৌসুম শুরুর পর বাঁশখালী ও কক্সবাজারের কুতুবদিয়া এবং অন্যান্য এলাকায় কয়েক হাজার মেট্টিন ট্রন লবণ ইতিমধ্যে উৎপাদন হয়েছে।
জানা গেছে, ধানকাটা শেষের পর পরই লবণ চাষের কার্যক্রম শুরু হয়। গত মৌসুমে লবণের ন্যায্য মূল্য পাওয়ায় এবারো আশা নিয়ে মাঠে নেমেছেন হাজারো চাষি। শ্রমিক ও প্রয়োজনীয় আনুষাঙ্গিক সামগ্রীসহ মাঠে লবণ চাষের কাজ উদ্বোধন করেন। মৌসুমের শুরুতে প্রথম লবণ উৎপাদন হয় বাঁশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলায়। পলিথিনে উৎপাদিত লবণ বিক্রি হয়েছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায়।
কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী ও ঈদগাঁওর পোকখালী এবং গোমাতলীতে গিয়ে দেখা গেছে, চাষিরা মনোযোগী হয়ে মাঠে কাজ করছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চাষীরা আনন্দে লবণ উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
অনেক চাষি ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দেশে লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্র কক্সবাজার জেলা ও বাঁশখালী। এখানকার উৎপাদিত লবণ সারাদেশের মানুষ খাওয়ার পর বিদেশেও রফতানি সম্ভব। কিন্তু সরকারকে একশ্রেণীর দালালচক্র ভুল বুঝিয়ে লবণ আমদানি করে দেশীয় এ শিল্পের ক্ষতি করে।
গোমাতলীর লবণচাষি রিদুয়ানুল হক বলেন, কক্সবাজারের খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, ঈদগাঁওর পোকখালী, গোমাতলী, মহেশখালীর প্রায় প্রতিটি ইউনিয়ন, পেকুয়া, চকরিয়া, টেকনাফসহ উপকূলীয় এলাকায় লবণ চাষীরা পুরোদমে মাঠে নেমেছে। তবে, সরকারের কাছে দাবি কোনো চক্র যেন লবণ আমদানি করতে না পারে।
চৌফলদন্ডীর জিয়াবুল হক বলেন, একজন শ্রমিক এক একর জমি চাষ করতে পারে। চলতি মৌসুমে একর প্রতি জমি লিজ নিতে হয়েছে ৭৫ হাজার টাকায়। পুরো মৌসুমে একজন শ্রমিকের মূল্য এক লাখ ১০ হাজার টাকা। মৌসুম শেষ পর্যন্ত খাবার, পলিথিন মিলিয়ে খরচ হবে এক লাখ টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে একরে ৭৫০ মণ লবণ উৎপাদন সম্ভব। শুরু হতে মৌসুম শেষ পর্যন্ত গড়ে ৫০০ টাকায় লবণ বিক্রি সম্ভব হলে একরে উৎপাদিত লবণে আয় হবে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা। আর কোনো কারণে লবণের দাম পড়ে গেলে সব লবণচাষিকে আর্থিক লোকসানে পড়তে হবে। লবণই একমাত্র পণ্য যা দেশে চাহিদা মেটানোর পরিমাণ উৎপাদন হয়। তাই কেউ মিথ্যে তথ্যে যেন বিদেশ থেকে লবণ আমদানির সুযোগ না পায়, তা নিশ্চিত করতে বাণিজ্য ও প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করছি।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ মৌসুমে দেশে লবণের চাহিদা রয়েছে ২৫ দশমিক ২৮ লাখ মেট্রিক টন। ২০২৩-২৪ মৌসুম শুরুতে মাঠ পর্যায়ে লবণ মজুদ ছিল ১ দশমিক ৬০ লাখ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ মৌসুমে দেশে লবণের চাহিদা ছিল ২৩ দশমিক ৮৫ লাখ মেট্রিক টন। এ মৌসুমে লবণ উৎপাদন হয় ২২ লাখ ৩২ হাজার ৮৯০ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ মৌসুমেও উদ্ধৃত উৎপাদন ছিল। এ মৌসুম ও গত মৌসুমে জমির পরিমান ছিল ৬৩ হাজার ২৯১ একর। ২০২৩-২৪ মৌসুমে লবণের মূল্য নির্ধারণ হয়েছে ৫২৬ টাকা মণ।
বিসিকের বৃহৎ লবণ কেন্দ্র রয়েছে-কুতুবদিয়ার লেমশি খালী, উত্তর নলবিলা, মহেশখালীর গোরকঘাটা, মাতারবাড়ি, ঈদগাঁওর গোমাতলী, সদরের চৌফলদন্ডী, পেকুয়ার দরবেশকাটা, চকরিয়ার ডুলাহাজারা ও ফুলছড়ি, টেকনাফ, বাঁশখালীর পুর্ব বড়ঘোনায়।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের (বিসিক) লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয় কক্সবাজারের পরিদর্শক (উন্নয়ন) মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী জানান, নভেম্বরের শুরুতে বর্ষা ধানের চাষ উঠে যায়। এরপর লবণের মাঠ তৈরিতে নামে চাষিরা। মৌসুম চলাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টি না হলে, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লবণ চাষিরা বেশ উপকৃত হবে। গত বছর লবণের ন্যায্যমূল্য পাওয়ায় প্রান্তিক চাষিরা এবার ফুরফুরে মেজাজে মাঠে নেমেছে। গত বছরের চেয়ে এবার লবণের গড়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫২৬ টাকা।
সায়ীদ আলমগীর/এএইচ/এএসএম