বাঁশখালীতে পুলিশি আতঙ্ক
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকার বিভিন্ন স্থানে এখনো ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে। শোকে ও আতঙ্কে নিরব স্তব্ধ গ্রামটিতে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে নারী কণ্ঠের বিলাপ ও কান্নার শব্দ। মাত্র দুদিন আগে ঝরে গেছে ৪টি তাজা প্রাণ। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে অনেকে। সে শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি গ্রামবাসী।
সরজমিনে দেখা যায়, বাঁশখালীর উত্তর গন্ডামারা চরপাড়া এলাকার আশরাফ আলীর বাড়িতে অসংখ্য মানুষের ভীড়। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় দূরদূরান্ত থেকে এসেছেন স্বজনরা। স্বজনদের কাছে পেয়ে কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে পরিবেশ। শোকে কালো পতাকা উড়ছে সর্বত্র। তবে এ ঘটনায় ৩ হাজার জনকে আসামি করে মামলা করায় অনেকেই এখন এলাকা ছাড়া। তাই চাপা ক্ষোভ ও শোকের পাশাপাশি বিরাজ করছে পুলিশি আতঙ্ক।
আইন-শৃংখলা বাহিনী সদস্যদের ঠেকাতে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা কেটে দিয়েছে এলাকাবাসী। গত দুই রাত থেকে গন্ডামারা ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রবেশ পথে পাহারা বসানো হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের লোক নয় এটা নিশ্চিত হয়েই গ্রামে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন তারা।
নিহত জাকের আহমদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, মা-বোনের কান্না, আত্মীয়-স্বজনের আহাজারি ও প্রতিবেশীদের সান্তনায় পরীক্ষার হলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তসলিমা (নিহত জাকিরের মেয়ে)। কান্নার শব্দ আর বাড়ির সামনে বাবার কবর দেখে চলে যায় পরীক্ষার দিতে।
সোমবার বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী মিছিলে গিয়েছিলেন তিন ভাই। নিজে অক্ষত ফিরলেও দুই ভাই মর্তুজা আলী (৬০) ও আনোয়ার হোসেন (৫৫)কে হারিয়ে ভেঙ্গে পড়েছেন বদি আহমদ। সে দিনের ঘটনা বর্ণনা দিতে গেয়ে বার বার কান্নায় বুক ভাসালেন তিনি।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, চোখের সামনেই দুই ভাইকে মরতে দেখলাম। অথচ আমি বেঁচে রইলাম। মিছিলে আমরা তিন ভাই পাশাপাশি ছিলাম। গুলি খেয়ে তারা দুজন পড়ে যায়। মর্তুজার বুকে গুলি লাগে, আনোয়ারের লাগে অন্ডকোষ ও গলায়। মর্তুজা পানি চাইল, পানি দেয়ার পর চোখ বন্ধ করল, আর খোলেনি। আনোয়ারও পানি চেয়েছিল, কিন্তু শেষ বারে মত ভাইকে পানি দিতে পারিনি। এ কষ্ট আমাকে আজীবন বইতে হবে।
মাত্র কয়েক ঘণ্টার ঘটনায় পাল্টে গেছে পুরো বাশঁখালির চিত্র। ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকায় এস আলম গ্রুপ ৬শ’ একর জমির ওপর বিদ্যৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়ার পর থেকে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। এলাকাটিতে রয়েছে লবণমাঠ এবং কৃষি জমি। স্থানীয়দের দাবি, ভিটে আর জীবিকা হারানোর শঙ্কা থেকেই মূলত এ বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী তারা।
সে দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে মাহবুব, মোসলেম, কামাল উদ্দিন (মেম্বার)সহ এলাকাবাসীরা অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তির অতি উৎসাহের কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। তা না হলে পুলিশ গুলি চালাত না। এখনো অনেক লোক গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রয়েছে, কিন্তু চিকিৎসা করার সাহস পাচ্ছে না। বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া আহত অনেককে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে।
নিহত মর্তুজা ও আনোয়ারের ভাই বদি আহমদ বলেন, আমরা কোনো দল করি না। সমাবেশ ডেকেছে তাই গিয়েছিলাম। দুই ভাই নিহতের সুষ্ঠু বিচার দাবিও করেন তিনি।
মর্তুজার স্ত্রী (প্রথম) নুরজাহান বেগম বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রে আমাদের কোনো জায়গা নেই। স্বামী গিয়েছিল শুধু প্রতিবাদ করতে। কেন তাদের মেরে ফেলা হল? আমরা কি বিচার পাব না?
গন্ডামারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আরিফ উল্লাহ এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করে বলেন, সরকারে সিদ্ধান্তে এ ইস্যূর সমাধান হবে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ঘটনার পরবর্তি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে প্রশাসন। নতুন করে এ মুহূর্তে কোন ইস্যূ যাতে তৈরি না হয়। সে ব্যাপারে প্রশাসন চেষ্টা করছে। বাঁশখালির পরিস্থিতি এখন অনেকটা শান্ত।
বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ স্বপন কুমার মজুমদার বলেন, মামলা অনুয়াযী তদন্ত এগিয়ে নেয়া হবে। পরিস্থিতি শান্ত হলে পুলিশ মামলা অগ্রগতির ব্যাপারে চিন্তা করবে। তবে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, যারা দোষী এবং পুলিশের উপর হামলা চালিয়েছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। তবে কোনো নীরিহ মানুষ যেন হয়রানীর শিকার না হয় সে ব্যাপারে পুলিশ সর্তক আছে।
উল্লেখ্য, গত ৪ এপ্রিল (সোমবার) দুপুরে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও গ্রামবাসীর মধ্যে সংর্ঘষে ৪ জন নিহত ও পুলিশসহ কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়। ঘটনার পর থেকে পুরো বাঁশখালিতে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ। পুলিশ ও নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে পৃথক তিনটি মামলায় ৩ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে।
আরএস/পিআর