পকেটে টাকা না থাকলেও পেটপুরে খাবার মেলে খোরশেদের হোটেলে
জিনিসপত্রের চড়া দামে যখন সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছেন তখন বিনামূল্যে হতদরিদ্র মানুষদের খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে চমক সৃষ্টি করেছেন খোরশেদ আলম ভুইঁয়া নামের এক হোটেল মালিক। এরইমধ্যে তার এই হোটেলটি সিদ্ধিরগঞ্জে ‘গরিবের হোটেল’ নামে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে।
কয়েকদিন আগে হোটেলের ক্যাশবাক্সের সামনে ঝুলানো একটি ব্যানার ফেসবুকে পোস্ট করেন এক ব্যক্তি। যেটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। যে ব্যানারে লেখা ছিল ‘পেটে ক্ষিদা কিন্তু পকেটে টাকা নেই, চিন্তা ছাড়া দোকানের মালিককে বলে খেয়ে নিন।’
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড় এলাকার খানকা মসজিদের সামনে অবস্থিত এই হোটেলটির নাম চিটাগাং হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। রোববার (১৪ জানুয়ারি) দুপুরে সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন জায়গা থেকে হতদরিদ্র মানুষেরা এই হোটেলে খুশিমনে আসেন খাবার খেতে। যাদের মধ্যে অধিকাংশেরই দিন কাটে ভিক্ষা করে। তাদের জন্য হোটেলের খাবার মেন্যুতে থাকে মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, সবজি ও নানা খাবার। একবেলা ভালো পরিবেশে ভালো খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর ফেলেন তারা। দু’হাত তুলে দোয়া করেন হোটেল মালিকের জন্য। এভাবেই গত কয়েক মাস ধরে একবেলা খাবার খাওয়াচ্ছেন খোরশেদ আলম ভুঁইয়া।
কাঁচপুর থেকে হোটেলটিতে খাবার খেতে আসা বৃদ্ধা নূরজাহান বেগম বলেন, ‘আমি সবসময় এখানে আহি। আমার স্বামী ঘরে পঙ্গু। আমার এখন চলার পথ নাই। ভিক্ষা করে খাই। দুইটা মেয়েরই বিয়া হইয়া গেছে। পরের পোলারাতো আমাগো সংসার চালাইবো না। গেছে শনিবার আামি এহানে আইছিলাম ভিক্ষা চাইতে। তখন তারা ভিক্ষা না দিয়া আমারে কইছিল হোটেল থেকে খাইয়া যাইতে। আজকে আবার আইছি দুইটা খাওয়ার লাইগ্গা। খাবার অনেক ভালাই। আমাগো ভাগ্যে যা আছিল তাইই খাইছি। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শোকর। তারা আমারে যেভাবে আদর যত্ন করে খাওয়াইলো তাই তাগো জন্য মোনাজাত কইরা দোয়া করমু। আল্লাহ যেনো হেগো মনের আশা পূরণ করে। যেন তারা আরও মানুষগো খাওয়াইতে পারে।’
নূর মোহাম্মদ নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘আমি ভিক্ষা কইরাই খাই। এখানে সবসময় আসা হয় খাওয়ার জন্য। এখানে খাইয়া আমাগো ভালোই লাগে। তাগো কারণে আমাগো অনেক উপকার হইতাছে। এহানে আমরা পেট ভইরা খাইতে পারতাছি।’
ভিক্ষা করে বেঁচে আছেন বানু বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী অনেক আগেই মারা গেছে। এহন আমি সাহায্য চাইয়া খাই। হেরা আমাগো খাওয়াইয়া রুহু যেমনে ঠান্ডা করছে আল্লাহ যেন হেগো আরও তাজা কইরা দেয়। আইজ আমি মুরগির মাংস, ডাইল দিয়া খাইলাম। আল্লাহ আজ ভালোই খাওয়াইছে। একেকদিন এহানে একেক খাওয়ান খাওয়ায়। এখানকার খাওন অনেক মজার।’
হোটেলে নিয়মিত খাবার সরবরাহকারী মামুন নামের এক কর্মচারী বলেন, আমি এই হোটেলে প্রায় তিনমাস ধরে কাজ করে আসছি। প্রতি সপ্তাহে নিজ দায়িত্বে আমি তাদের খাবার পরিবেশন করে থাকি। এই কাজ করতে পেরে নিজের কাছেও অনেক ভালো লাগে। অনেক সময় মহাজন না থাকলেও তারা বিভিন্ন খাবার চাইলে আমি দিয়ে দেই। এ কারণে কয়েকজনের সঙ্গে আমারও সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে। অনেকেই আমাকে দেখলে এখন বলে বাজান কেমন আছো। তারা আমাকে অনেক আদর করে।
হোটেলটির মালিক মো. খোরশেদ আলম ভুইঁয়া বলেন, ৩-৪ মাস ধরে আমি এই উদ্যোগটা নিয়েছি। উদ্যোগটি নেওয়ার পর হতদরিদ্র অনেক মানুষ আছেন যাদের টাকা দিয়ে খাওয়ার সামর্থ্য নেই, তারা আমার হোটেলে এসে খাবার খায়। আমি চাই আমার মতো অনেকেই এভাবে যেন এগিয়ে আসে। আমি প্রতি রোববার তাদের নিয়ে বিশেষ আয়োজন করে থাকি। একেক সপ্তাহে তাদের জন্য একেক খাবারের আয়োজন করে থাকি। তাদের এভাবে বিনামূল্যে খাওয়ানোর ফলে আমার কোনো লোকসান হচ্ছে না। এর কারণ আল্লাহ পাকের ইচ্ছাতেই আমি তাদের খাওয়াতে পারছি। আল্লাহ না চাইলে আমি তাদের খাওয়াতে পারতাম না।
তিনি বলেন, আমার এখানে মোট ১৮ জন স্টাফ কাজ করেন। তাদের সবার বেতন দেওয়ার পরও আমার হোটেল চালাতে কখনো হিমশিম খেতে হয়নি। প্রতি রোববার গড়ে ২৫-৩০ জন মানুষ খাওয়া দাওয়া করতে আমার হোটেলে আসেন। আমি কখনো এসব গণনা করি না। কারণ গণনা করার কোনো প্রয়োজন আমি মনে করি না। রিজিকের মালিক আল্লাহ। আমার মাধ্যমে তাদের রিজিক হচ্ছে এতেই আমি খুশি। রোববার ছাড়াও সপ্তাহের অন্যান্য দিন যদি কেউ এসে বলে, আমি ক্ষুধার্থ, আমার কাছে কোনো টাকা নেই, তাহলে আমি চুপিসারে তাদেরকে হোটেলে বসিয়ে খাওয়ায় দিই।
রাশেদুল ইসলাম রাজু/এফএ/জেআইএম