ঋণের জালে বন্দি শতাধিক জেলে পরিবার
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ঋণের জালে বন্দি হয়ে পড়েছে তিনটি জেলেপাড়ার শতাধিক মানুষ। মৌসুমে সাগরে পর্যাপ্ত ইলিশ না পাওয়ায় একাধিক এনজিও ঋণ ও দাদনের চাপে পরিবারগুলো দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সাগরে যা মাছ পাওয়া যায় সেটি বিক্রি করে মাছ ধরার খরচ যোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। ফলে কিস্তি যোগাড় করতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।
উপজেলার সাহেরখালী জলদাসপাড়া, মির্জানগর জলদাসপাড়া ও মায়ানী ইউনিয়নের মির্জানগর জলদাস পাড়ায় প্রায় দেড় শতাধিক জেলে পরিবারের বসবাস। এদের মধ্যে ১২০ পরিবারের আড়াইশ মানুষ মাছ ধরার পেশার সঙ্গে জড়িত। প্রতি বছর ইলিশ মৌসুম এলে তাদের চোখে-মুখে কিছুটা আনন্দ ফুটে উঠে। সাগর থেকে ইলিশ ধরার জন্য সংগ্রহ করতে নতুন নতুন ইলিশ জাল, তৈরি করা হয় ইঞ্জিনচালিত নৌকাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। সরঞ্জামগুলো সংগ্রহ করতে বিভিন্ন এনজিও ও দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেন লাখ লাখ টাকা ঋণ। এ বছর তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু এবার বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেলে চাহিদা অনুযায়ী ইলিশ না পাওয়ায় জেলে পরিবারগুলোতে নেমে আসে হতাশা। আটকা পড়ে ঋণের জালে। রাত পোহালে কোন না কোন এনজিওর কিস্তির কারণে পরিবারগুলোতে দেখা দেয় অস্থিরতা।
আরও পড়ুন: নৌকা ভেঙে মানবেতর জীবন কাটছে শতাধিক জেলের
৩০ বছর ধরে সাগরে মাছ ধরছেন সাহেরখালী জলদাসপাড়ার রবিন্দ্র জলদাস। এবছর ইলিশ মৌসুমের শুরুতে জাল, তিনটি ইঞ্জিনচালিত নৌকাসহ নানান সরঞ্জাম কিনতে তিনটি এনজিও থেকে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। ইলিশ ধরার আশায় সাগরে জাল ফেললেও বালুবোঝাই পাইবার বোট সবগুলো জাল তছনছ করে দেয়। ফলে সাগর থেকে চলতি মৌসুমে তেমন মাছ ধরতে পারেননি। এখন ঋণের কিস্তি যোগাড় করতে গিয়ে এক মেয়ে ৩ ছেলে নিয়ে কষ্টে দিন যাপন করছেন।
তিনি আরও জানান, টাকার অভাবে বড় ছেলে আয়ন জলদাসের এইচএসসি ১ম বর্ষের পরীক্ষার ফি দিতে না পারায় পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যায়।
জয়নগর জলদাস পাড়ার প্রাণ হরি জলদাস জানান, বোট ও জাল ক্রয় করতে একটি এনজিও থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। দুটি ইঞ্জিন নৌকায় ১০ জন মানুষ মাছ ধরার কাজ করতেন। পুরো মৌসুমে মাত্র ৫ মণ ইলিশ পেয়েছি। পর্যাপ্ত ইলিশ না পাওয়ার এখন ঋণের জালে আটকা পড়েছি। এর মধ্যে সাগরে ২২ দিন মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা গেছে। এখন সাগরে মাছ ধরতে পারলেও তেমন মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।
অর্ধ যুগেরও বেশি সময় ধরে মাছ ধরা পেশার সঙ্গে জড়িত দিনেশ জলদাস জানান, চলতি বছর মাত্র আড়াই মণ ইলিশ মাছ ধরতে পেরেছেন। কিন্তু মৌসুমের শুরুতে একটি ব্যাংক থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। বর্তমানে সাগরে তেমন মাছ না পাওয়ায় ঋণের কিস্তির টাকা যোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
মৃগঙ্গ জলদাস জানান, তার একটি বোট রয়েছে। মৌসুমের শুরুতে বোট মেরামত ও জাল ক্রয় করতে তিনটি এনজিও থেকে দুই লাখ টাকা ও পচা ইলিশ দেওয়ার জন্য এক দাদন ব্যবসায়ী থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু এ মৌসুমে মাত্র মাছ পেয়েছে ৪ মণ। সাগরে ইলিশ না পাওয়ায় ঋণের বেশির ভাগ টাকা রয়েছে গেছে।
জগন্নাথ জলদাস জানান, জেলে পরিবারগুলোর প্রত্যেকে বিভিন্ন এনজিও থেকে লাখ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে এখন প্রতিদিন কোন না কোন এনজিও’র কিস্তি যোগার করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। একদিন এক এনজিও’র কিস্তি দিয়ে আবার পরের দিনের কিস্তি যোগার করতে গিয়ে সংসার খরচের জন্য আর টাকা থাকে না। ছেলে মেয়েদের কখনও কখনও শুধু লবণ দিয়েও ভাত খেতে হয়।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে মিরসরাইয়ের সন্দ্বীপ চ্যানেল থেকে ৩২৬ টন, ২০২১ সালে ২৫২ টন, ২০২৩ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪০ টনের মতো ইলিশ ধরা পড়েছে।
মিরসরাই উপকূলীয় জেলে সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হরিলাশ জলদাস জানান, সাগর থেকে বালু উত্তোলনের কারণে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। বালু উত্তোলনের জ্রেজার মেশিন চলার কারণে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ স্থান পরিবর্তন করে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। ফলে জেলেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মিরসরাই উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাছিম আল মাহমুদ জানান, বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেল দিয়ে সাহেরখালী, ডোমখালী ও মঘাদিয়া ইউনিয়নের জেলেরা সাগরে বিভিন্ন মাছ ধরে। ইলিশ মৌসুমে এখানে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যেত। কিন্তু এ অঞ্চলে শিল্পজোন কেন্দ্রিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে মাছের বিচরণ ক্ষেত্রের স্বাভাবিক পরিবেশকে হয়তো বাঁধাগ্রস্ত করায় মাছ অন্য অঞ্চলে সরে গেছে।
এমএমডি/আরএইচ/এমএস