এমপি জিন্নাহর সম্পদের পাহাড়
<> ১.৪০ থেকে ১৬৯৩.২২ শতক জমির মালিক
<> বাড়ি ভাড়ায় আয় বেড়েছে ২৩৪ গুণ
<> ১৩১ গুণ বেড়েছে কৃষি থেকে আয়
<> স্ত্রীর নগদ অর্থ ও ব্যাংক হিসাব বেড়েছে ১৪৪ গুণ
মাত্র পাঁচ বছরে কৃষিজমি বেড়েছে ১২০০ গুণ। ১৩১ গুণ বেড়েছে কৃষি থেকে আয়। বাড়ি ভাড়ায় আয় বেড়েছে ২৩৪ গুণ। পাঁচ বছর আগে স্ত্রীর নগদ অর্থ ছিল দেড় লাখ টাকা। ছিল না কোনো ব্যাংকের হিসাব। ২০২৩ সালে এসে স্ত্রীর নগদ অর্থ ও ব্যাংক হিসাব বেড়েছে ১৪৪ গুণ।
যার সম্পদের কথা বলা হচ্ছে তিনি হলেন এমপি শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ। সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তা বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় এক কোটি ৫৯ লাখ ৭৮ হাজার ১১৩ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৮৯ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৮ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ করা হয়। ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ কমিশনের উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
মামলা দুটির তদন্ত এখনো চলছে। তবে এসব মামলা মাথায় নিয়েই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনী জাতীয় পার্টি থেকে প্রার্থী হয়েছেন জিন্নাহ। একইসঙ্গে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে সম্পদ বিবরণীতে তিনি দেখিয়েছেন নতুন চমক।
শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও বগুড়া জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি। তার স্ত্রী মহসিনা আক্তার পেশায় গৃহিণী। দুজনে মিলেমিশে এভাবে সম্পদের মালিক হয়েছেন। বেড়েছে প্রার্থীর ওপর নির্ভরশীলদের আয়।
সম্পদ বিবরণীর তথ্য বলছে, পাঁচ কোটি ২৯ লাখ ৪১ হাজার ৩৬২ টাকার মালিক জিন্নাহ। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তার সম্পদ বেড়েছে পাঁচগুণ। স্ত্রীর সম্পদের পাহাড়ে জমা হয়েছে দুই কোটি ৬২ লাখ ৭ হাজার ১০৩ টাকা। এরমধ্যে নগদ অর্থ ও ব্যাংক হিসাব মিলে আছে দুই কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৩০ টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে স্ত্রীর ব্যাংক আমানত ও নগদ অর্থ বেড়েছে অন্তত ১৪৪ গুণ।
এবারের হলফনামায় জিন্নাহ নিজের ব্যবসায়িক পুঁজি হিসেবে নগদ ৯৭ লাখ ৯৩ হাজার ২৭৬ টাকা দেখিয়েছেন। তার স্ত্রীর নামে রয়েছে এক কোটি ২৫ লাখ ৮৭ হাজার ১৩৪ টাকা। আর তার ওপর নির্ভরশীলদের নামে দেখানো হয় ৯৩ লাখ ৫৫ হাজার ২৮২ টাকা। অথচ একাদশের হলফনামায় স্ত্রীর নামে নগদ দেখানো হয়েছিল ছিল মাত্র এক লাখ ৫০ হাজার টাকা। তারও পাঁচ বছর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তার নগদ টাকা দেখানো হয় ৫০ হাজার টাকা।
অস্থাবর সম্পদ হিসেবে ব্যাংকে জিন্নাহর জমা আছে ৭২ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮ টাকা। তার স্ত্রীর ৬২ লাখ ৮৩ হাজার ১৯৬ এবং নির্ভরশীলের আছে এক লাখ ৭৩ হাজার ৩৫৩ টাকা।
২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নির্বাচিত হন। এবার কৃষিখাতে জিন্নাহর আয় দুই লাখ ৬১ হাজার ৬৩০ টাকা। অথচ দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় কৃষিখাতে আয় ছিল মাত্র দুই হাজার টাকা। বাড়ি, দোকান ভাড়া থেকে এখন আয় চার লাখ ২০ হাজার ৫০০ টাকা। তবে পাঁচ বছর আগেও এ খাতে আয় ছিল মাত্র এক হাজার ৮০০ টাকা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী হলফনামায় কৃষিখাতে প্রার্থীর ওপর নির্ভরশীলদের উপার্জন দেখানো হয় ২৪ হাজার ৭২০ টাকা। বাড়ি ভাড়া ৬০ হাজার টাকা। যদিও এ দুই খাতে আগে কোনো আয় ছিল না।
ব্যবসায়িক খাতে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে জিন্নাহর আয় ছিল তিন লাখ ১৫ হাজার ৮০০ টাকা। এবার তার ব্যবসায়ে আয় ঘোষণা দেওয়া হয় সাত লাখ টাকা। নির্ভরশীলদের ব্যবসা থেকে আয় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
বছরে আয় হিসেবে ব্যাংকে জিন্নাহর আছে এক লাখ ৩৩ হাজার ৭৫৬ টাকা। নির্ভরশীলদের নামে আছে তিন লাখ ২৪ হাজার ৪৮০ টাকা। পেশাখাতে নির্ভরশীলদের আয় দেখানো হয়েছে ছয় লাখ ৭৬ হাজার টাকা। এছাড়া মেসার্স ইসলাম ইট প্রস্তুতকারক নামে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। চাকরি খাতে জিন্নাহর আয় ছয় লাখ ৬০ হাজার টাকা। আর সংসদ সদস্য হিসেবে বছরে সম্মানী পান ১৯ লাখ ৩৯ হাজার ৬৭৫ টাকা।
জিন্নাহর স্ত্রী মহসিনা আক্তার উপজেলার মোকামতলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি। এর বাইরে তার কোনো পেশার হদিস কারও জানা নেই। তার বড় ছেলে হুসাইন শরীফ সঞ্চয় বাবার সঙ্গে ব্যবসা করেন। আর ছোট ছেলে তাজবীর শরীফ ঢাকায় থাকেন। ১০ বছর আগে স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা থাকলেও জিন্নাহর নামে কিছু ছিল না। পাঁচ বছরের ব্যবধানে জিন্নাহর ব্যাংকে জমা হয় ৫০ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৭ টাকা। তার পাঁচ বছর পর এবার এ খাতে বেড়েছে ২২ লাখ ৪ হাজার ২৮১ টাকা।
গত ১০ বছরে জিন্নাহ বা তার স্ত্রীর সঞ্চয়পত্র না থাকলে এবার স্ত্রী মহসিনার নামে ২৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেখানো হয়। এসব হিসাবের বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাঁচ বছরের ব্যবধানে জিন্নাহর স্ত্রীর নগদ ও ব্যাংক আয় বেড়েছে ১৪৪ গুণ।
১০ বছর আগে জিন্নাহর ৭৭ হাজার টাকার একটি মোটরসাইকেল ও স্ত্রীর পাঁচ লাখ টাকার গাড়ির ছিল। একাদশে এসে মোটরসাইকেলের পাশাপাশি ৩৬ লাখ ৭৪ হাজার ৯১৯ টাকার ল্যান্ড ক্রুজার যোগ হয়। আর এবার জিন্নাহর নামে এক কোটি ১ লাখ টাকার একটি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার ছাড়াও স্ত্রীর নামে ১৫ লাখ ২৫ হাজার টাকার একটি ট্রাকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
পাঁচ বছর আগে অস্থাবর সম্পত্তির অন্যান্য খাতে আড়াই লাখ মূল্যের একটি পিস্তল ও মিনি রাইফেলের কথা জানিয়েছিলেন জিন্নাহ। কিন্তু দ্বাদশ নির্বাচনে এ খাতে তার অস্ত্র দুটির কথা উল্লেখ করেননি তিনি।
হলফনামার তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এমপি জিন্নাহর ১ দশমিক ৪০ শতক কৃষিজমি থেকে বেড়েছে ১২০০ গুণ। বর্তমানে তিনি এক হাজার ৬৯৩ দশমিক ২২ শতক কৃষিজমির মালিক। এর মূল্য জানিয়েছেন ৪৫ লাখ ৫০ হাজার ১৫০ টাকা। পিছিয়ে নেই তার স্ত্রীও। মাত্র সাত শতকের কৃষিজমি থেকে বেড়ে এখন হয়েছে ১৫৬ দশমিক ৮ শতক। মূল্য দেখানো হয়েছে ২৭ লাখ ১১ হাজার ৮০০ টাকা।
জিন্নাহর অকৃষি জমির মূল্য দেওয়া আছে ১০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। স্ত্রীর অকৃষি জমি না থাকলেও তাদের নির্ভরশীলের নামে আছে ১০ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের অকৃষি জমি।
এমপি জিন্নাহর নামে এক কোটি ৮৯ লাখ ৬১ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের দুটি দালান এবং ১৫ লাখ ৯২ হাজার ১৯৫ টাকার একটি ফ্ল্যাট আছে বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে।
হলফনামায় জিন্নাহ নিজের নামে দুটি ব্যাংক ঋণের কথা জানিয়েছেন। তার নামে মধুমতি ব্যাংক লিমিটেডের মতিঝিল শাখা থেকে পাঁচ লাখ ২৮ হাজার এবং রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের মহাস্থানগড় শাখা থেকে ৩০ লাখ ৯০ হাজার টাকা ঋণ রয়েছে। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের মহাস্থানগড় শাখা থেকে নির্ভরশীলদের নামে ৪৯ লাখ ৪৭ হাজার টাকার ব্যাংক ঋণ দেখানো হয়েছে।
এসআর/এএসএম