একদিনের বৃষ্টিতে নষ্টের পথে ২০০ কোটির বীজ আলু

আরাফাত রায়হান সাকিব আরাফাত রায়হান সাকিব , মুন্সিগঞ্জ
প্রকাশিত: ০৪:২৫ পিএম, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩

নিম্নচাপের ফলে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার দিনভর বৃষ্টিপাতে মুন্সিগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় আবাদকৃত বীজ আলুর জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে রোপণ করা এসব বীজ আলু পচে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে আবারো বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছেন দেশের আলু উৎপাদনে শীর্ষ এ জেলার চাষিরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত ৬ উপজেলায় ১৬ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। তবে কৃষকরা বলছেন, আলু আবাদের পরিমাণ এর থেকেও বেশি। একদিনের বৃষ্টিতে রোপণ করা আলুর ৭০-৮০ ভাগই পচে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বৃষ্টি দীর্ঘমেয়াদী হলে নষ্ট হবে সব বীজ। মৌসুমের শুরুতেই প্রকৃতির এমন বৈরিতায় দিশেহারা তারা।

বৃহস্পতিবার জেলার সদর ও টঙ্গীবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কোথাও পানিতে তলিয়ে গেছে আলুর জমি, কোথাও জমিতে জমাট বেঁধেছে পানি। আলুর উপরের জন্য চাষ দিয়ে প্রস্তুত করা জমি পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও আলুর জমিতে নালা করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করেছেন কৃষকরা। তবে কষ্টের টাকা দিয়ে আবাদ করা জমির এমন হাল দেখে হতাশ তারা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় আলু রোপণ শুরু হয়। বুধবার (৬ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ৬ উপজেলায় ১৬ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। সাধারণত হেক্টরপ্রতি ২ হাজার কেজি বা ৫০ মণ বীজ আলু রোপণ করা হয়।

তবে চাষি ও ব্যবসায়ী সমিতি বলছে, মুন্সিগঞ্জে হেক্টর প্রতি বীজ লেগেছে ২ হাজার ৬৫০ কেজি বা ৬৬ মণের বেশি। সে হিসাবে ১৬ হাজার ২০০ হেক্টরে বীজ রোপণ করা হয়েছে প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার মণ আলু। কৃষকদের হিসাবে হেক্টর প্রতি বীজ আলুতে খরচ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৭৫০ টাকা। অর্থাৎ বীজ আলুতে ২৩৬ কোটিরও বেশি টাকা খরচ হয়েছে। যা এখন পানিতে।

বীজ ছাড়াও প্রতি হেক্টর জমিতে এবার আলু আবাদে সার লেগেছে ১৬০০ কেজি। ২২ টাকা কেজি সারের হেক্টরে খরচ ৩৫ হাজার ২০০ টাকা। জমির ভাড়া ৭০ হাজার টাকা। শ্রমিক মজুরি হেক্টরে ৩৭ হাজার টাকা আর অন্যান্য খরচ ১৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ হেক্টরপ্রতি ভাড়া নিয়ে চাষ করতে চাষিদের খরচ হয়েছে ৩ লাখ ২ হাজার ৯৫০ টাকা প্রায়। সে হিসাবে একদিনের বৃষ্টিতে ১৬ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা নষ্টের পথে।

খাসকান্দি এলাকার মো. সেলিম হাওলাদার বলেন, ৪ কানি জমিতে আলু রোপণ করেছিলাম। প্রতি শতাংশে ৩০-৩৫ কেজি আলু রোপণ করেছি। শ্রমিক, সার, খড়কুটো সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সব লস। এখন যদি ভাগ্যে থাকে তাহলে কিছুটা বাঁচবে।

দেওয়ান বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তমিজউদ্দিন খা বৃষ্টি মাথায় নিয়েই জমিতে নালা কেটে পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা করছেন। তবে প্রতিনিয়ত বৃষ্টিতে আবারো জমিতে জমাট বাঁধছে পানি। কষ্টের টাকায় আবাদ করা ফসল বাঁচাতে যেনো প্রকৃতির সঙ্গে তার ব্যার্থ লড়াই চলছে।

কথা হলে বৃদ্ধ এই কৃষক বলেন, আমাদের লাখ লাখ টাকা মাইর। ঋণ করে আলু লাগাইছি লাভের আশায়। প্রায় দুই-আড়াই লাখ টাকা খরচ হইছে। এখন জমির পানি বের করছি। কিন্তু একটু পরপর বৃষ্টিতে আবার তলায় (ডুবে) যায়।

এ বিষয়ে জেলা আলুচাষি ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের হেক্টরে বর্গা নিয়ে চাষ করতে খরচ হয়েছে ৩ লাখ ২ হাজার ৯৫০ টাকা। রোপণকৃত বীজ আলুর ৭০-৮০ শতাংশ নষ্ট হবে। বাকি আলুতেও আশানুরূপ ফলন হবে না। ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশো কোটি টাকা ছাড়াবে। এখন বীজ যদি পচে নষ্ট হয় তাহলে বীজ সংকটে পড়তে হবে চাষিদের। তাছাড়া আবারো আলু রোপণ করতে অনেকটা বিলম্ব হয়ে যাবে। এ বিষয়ে আমাদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হোক। অন্তত বীজ-সার সুলভমূল্যে পেলে আমাদের জন্য উপকার হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এবিএম ওয়াহিদুর রহমান বলেন, এখন যদি বৃষ্টি কমে যায় তাহলে ক্ষয়ক্ষতি তেমন হবে না। তবে দীর্ঘমেয়াদী হলে ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে। আমাদের পরামর্শ হলো, যেসব জমিতে পানি জমাট বেঁধেছে তা দ্রুত অপসারণ করতে হবে। পানি অপসারণ করা গেলে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যাবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. আব্দুল আজিজ বলেন, চাষিরা অনেক টাকা দিয়ে আবাদ করেছেন। তবে সব নষ্ট হবে না। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে জমির আলু কতখানি নষ্ট হয়েছে আর কতটুকু ভালো রয়েছে তা স্পষ্ট হবে। তখনই ক্ষতির পরিমাণ বলা যাবে। পরবর্তীতে সেই রিপোর্ট নীতিনির্ধারকদের কাছে পাঠানো হবে। তখন কোনো প্রণোদনা দেওয়া হলে কৃষকদের মাঝে বণ্টন করা হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. আব্দুল আজিজ আরও বলেন, অন্যান্য সময় ডিসেম্বরের এই সময় আলু রোপণ প্রায় শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এবার বিলম্ব হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়টি কৃষকদের আগেই অবহিত করা হয়েছিল। তাদের বলা হয়েছে ৬-৮ তারিখ বৃষ্টিপাত হতে পারে। এরপরই আলু রোপণ করতে হবে। তবে তারা সেটি মানেনি। এরমধ্যে আলু রোপণ করেছে। জেলার হিমাগারে এখনো ২৬ হাজার মেট্রিক টন বীজ আলু রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে ঘাটতি পড়বে না।

এফএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।