কুকি-চিন আতঙ্কে ঘরছাড়া

ফিরে আসা পরিবারগুলোতে খাদ্য সংকট

নয়ন চক্রবর্তী নয়ন চক্রবর্তী বান্দরবান প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৮:০৫ এএম, ২২ নভেম্বর ২০২৩

এপ্রিল-মে মাসে মৌসুমের প্রথম বৃষ্টি হলে জুম চাষ শুরু করেন পাহাড়ের বাসিন্দারা। এই ফসলই পাহাড়ের অনেক বাসিন্দার সারা বছরের খাদ্যের একমাত্র উৎস। চলতি বছরের শুরুতে পাহাড়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) আতঙ্ক শুরু হয়। আতঙ্ক চরমে পৌঁছায় এপ্রিল মাসে। ফলে চাষের মৌসুমে চাষাবাদ ফেলে প্রাণ বাঁচাতে পাহাড় ছেড়ে পালিয়ে যায় বান্দরবানের একটি পাড়ার ৯৭টি পরিবার। পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় পরিবারগুলো এখন পাড়ায় ফিরতে শুরু করেছে। তবে মৌসুমে চাষ করতে না পারায় অধিকাংশ পরিবারে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। এখন কেউ ধারদেনা করে, কেউ স্বজনদের সহযোগিতায় কোনো রকমে দিন কাটাচ্ছেন।

বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার রোয়াংছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পাইংক্ষ্যং পাড়ায় রোববার গিয়ে দেখা গেছে এমন মানবেতর দৃশ্য।

পাড়াবাসী জানান, পাহাড়ে জুম চাষই তাদের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিল মাসে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় জীবন বাঁচাতে বাড়ি-ঘর ছেড়ে প্রথমে জঙ্গলে, পরে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেন পাড়ার অধিকাংশ বাসিন্দা। এ কারণে এবার জুম চাষ করতে পারেননি তারা।

যারা পাড়ায় ফিরে এসেছে সবাই খাদ্য সংকটে আছে। কেএনএফের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধের পর আতঙ্কে সবাই পাড়া ছেড়ে বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেয়। এমন পরিস্থিতিতে পাড়ার কেউ জুম চাষ করতে পারেনি।

কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির প্রথমবারের মতো স্বশরীরে বৈঠক হয় গত ৫ নভেম্বর। বান্দরবানের রুমায় মুনলাই পাড়ার কমিউনিটি সেন্টারে এ বৈঠক হয়। এরপর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে পাড়া ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ৯৭ পরিবারের মধ্যে ৫৭টি পরিবার নিজ বাড়িতে ফিরেছে গত শনিবার। বাড়িফেরা পরিবারগুলোর অধিকাংশই জুম চাষ করতে পারেনি। ফলে পরিবারগুলোতে দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সংকট।

আরও পড়ুন>> কুকি-চিনের রক্তথাবায় বিপন্ন সবুজ পাহাড়

পাইক্ষ্যং পাড়ার কারবারি (পাড়াপ্রধান) পিতর বম জানান, গত এপ্রিল থেকে পাড়াবাসী যে যার মতো এলাকা ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল বিভিন্ন স্থানে। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় গত শনিবার (১৮ নভেম্বর) ৫৭ পরিবার নিজ গ্রামে ফিরে এসেছে। এসে দেখে যুদ্ধবিধ্বস্ত ঘরের মতো, কিছুই নেই।



ওই পাড়ার একজন নারী বাসিন্দা জিংপার বম। তিনি জানান, যারা পাড়ায় ফিরে এসেছে সবাই খাদ্য সংকটে আছে। কেএনএফের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধের পর আতঙ্কে সবাই পাড়া ছেড়ে পালিয়ে বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেয়। এমন পরিস্থিতিতে পাড়ার কেউ জুম চাষ করতে পারেনি।

অধিকাংশ পরিবার জুম চাষ করতে পারেনি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খামতাং ও পাইংক্ষ্যং পাড়ার লোকজন। তারা পাড়ায় ফিরে এলেও সবাই খাদ্য সংকটে পড়েছে। সংকট উত্তরণে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।

রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেহ্লা অং মারমা জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় পাইংক্ষ্যং পাড়া থেকে পালিয়ে যাওয়া অনেক পরিবার এখন নিজ এলাকায় ফিরে এসেছে। খাদ্য সংকটের বিষয়ে বান্দরবান জেলা পরিষদ, রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে মৌলিক চাহিদাগুলোর বিষয়ে সহায়তা দেওয়া হবে।

৩৪১ নম্বর পাইংক্ষ্যং মৌজার হেডম্যান বয় থাং বম জানান, তার মৌজায় শংখমনি পাড়া, রনিন পাড়া, মুনরেম পাড়া, লুংলেই পাড়া, ব্যাঙছড়ি মারমা পাড়া, রেপু তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া, ব্যাঙছড়ি পুনর্বাসন পাড়া, কাপ্লাং পাড়া, খামতাং পাড়া ও পাইংক্ষ্যং পাড়াসহ ১২টি পাড়ার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অধিকাংশ পরিবার জুম চাষ করতে পারেনি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খামতাং পাড়া ও পাইংক্ষ্যং পাড়ার লোকজন। তারা পাড়ায় ফিরে এলেও সবাই খাদ্য সংকটে পড়েছে। সংকট উত্তরণে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।

আরও পড়ুন>> বান্দরবানে অস্ত্রের মুখে ৪ শ্রমিককে তুলে নিলো কুকি-চিন

বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি লাল জার লম বম জানান, পাইংক্ষ্যং পাড়াবাসীর খাদ্য সংকটের বিষয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লার সঙ্গে কথা হয়েছে। জেলা পরিষদ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বান্দরবান সদর জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহমুদুল হাসান জানান, দীর্ঘ নয় মাস পর পাইংক্ষ্যং পাড়ায় এসে পাড়াবাসীকে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পাড়াবাসীর জন্য সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

কারা এই কেএনএফ?

কেএনএফ মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানকেন্দ্রিক আঞ্চলিক সংগঠন। পার্বত্য তিন জেলার প্রায় অর্ধেক আয়তনের অঞ্চল তথা লামা, রুমা, আলীকদম, থানচি, রোয়াংছড়ি, বিলাইছড়ি, জুরাইছড়ি, বরকলসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে একটি মনগড়া মানচিত্র তৈরি করেছে। যে মানচিত্রের তিনদিকে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত। এই মানচিত্র প্রস্তাবিত হিসেবে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সীমানা, জেলা ও উপজেলা সীমানা নির্ধারণ করেছে তারা।

সংগঠনের লোগোতে প্রতিষ্ঠাকাল ২০০৮ সাল উল্লেখ থাকলেও মূলত ২০১৮ সালের পর থেকে সশস্ত্র কাঠামোয় মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। কেএনএফের প্রধান নাথান বম ২০১৮ সালে বান্দরবান থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন>> ‘কেএনএফ’র কাছে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বাড়িছাড়া তরুণরা

নয়ন চক্রবর্তী/এমএইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।