প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এলডিডিপি প্রকল্পে অনিয়ম

‘ওই ঘরে মুরগি রাখলে গাড়োয়া ঠ্যাং টানি নিয়া যায়’

শামীম সরকার শাহীন
শামীম সরকার শাহীন শামীম সরকার শাহীন গাইবান্ধা
প্রকাশিত: ০৫:২৮ পিএম, ২৩ অক্টোবর ২০২৩

অডিও শুনুন

স্ক্যাভেঞ্জিং পোল্ট্রির পরিবেশবান্ধব শেড (ঘর) হওয়ার কথা ছিল চৌচালা। করা হয়েছে দো’চালা। চালে দেওয়ার কথা ছিল মেরুন রঙের ০.৪৫৭ মিমি গেজ পুরুত্বে ইন্ডাস্ট্রিয়াল টিন। দেওয়া হয়েছে ০.২৬০ মিমি গেজ পুরুত্বের ইন্ডাস্ট্রিয়াল টিন। টিনের তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য চালে ব্যবহার করা হয়নি ইনসুলেটর। বেড়ায় কেবলমাত্র প্লাস্টিকের জালি দেওয়া হয়েছে। অথচ সেখানে দেওয়ার কথা ছিল প্লাস্টিকে মোড়ানো ১৪ নম্বর গেজ জিআই তারের জালি। ১০ মিমি সাইজের রডের তৈরি দরজা দেওয়ার থাকলেও সেখানে দেওয়া হয়েছে কাঠের দরজা।

এছাড়া ১ ফুট উচ্চতার ১০ ইঞ্চি ইটের গাঁথুনির ৯টি পিলার হওয়ার কথা থাকলেও ৭টি পিলার করা হয়েছে। খুঁটি চারটির নিচে দেওয়া হয়নি কোনো ইট। অথচ প্রতিটি খুঁটির নিচে একটি করে ইট ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া আছে।

এমনই অনিয়ম পাওয়া গেছে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার স্ক্যাভেঞ্জিং পোল্ট্রির পরিবেশবান্ধব শেড নির্মাণে। খড়ি হিসেবে বিক্রি হবে এমন সব কাঠ দিয়ে শেডের বাটাম বানানো হয়েছে। কম পুরুত্বের প্লেনস্টিল ব্যবহার হয়েছে। এছাড়াও ব্যবহৃত কাঠের ধরন ও সাইজসহ নির্মাণ কাজের পরদে পরদে অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি) কর্তৃক গঠিত প্রডিউসার গ্রুপের (পিজি) সদস্যদের জন্য ইনভেস্টমেন্ট সাপোর্টের আওতায় মুরগির পরিবেশবান্ধব শেড (ঘর) নির্মাণের জন্য এ বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকল্পের অর্থ দিয়ে ঘর নির্মাণের লক্ষ্যে পিজি সদস্যদের সঙ্গে ৩০০ টাকার নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তিনামা সম্পাদন ও ফাঁকা চেকে স্বাক্ষর নেন ওই প্রকল্পের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

প্রতিটি শেড নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ২০ হাজার করে টাকা। সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ৫ ইউনিয়নে মোট ১৪৬ জনকে দেওয়া হয় সর্বমোট ২৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। অ্যাকাউন্ট-পে এই চেকের টাকা উপকারভোগীরা ছাড়া টাকা উত্তোলন সম্ভব না। আর শেড নির্মাণের কাজ উপকারভোগীদের সম্পাদন করার কথা থাকলেও প্রাণিসম্পদ অফিসের কর্মকর্তারা উপকারভোগীদের ছাড়াই এ টাকা উত্তোলন করে নিজেদের ইচ্ছামতো শেড নির্মাণের কাজ করেছেন।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর জানায়, উপজেলার তারাপুর, বেলকা ও সর্বানন্দ ইউনিয়নে ৩০টি করে এবং হরিপুর ও কঞ্চিবাড়ি ইউনিয়নে ২৮টি করে মোট ১৪৬টি পরিবেশবান্ধব মুরগির শেড নির্মাণের বরাদ্দ আসে। যা উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল বাস্তবায়ন করেছে।

‘ওই ঘরে মুরগি রাখলে গাড়োয়া ঠ্যাং টানি নিয়া যায়’

গত কয়েক দিন ধরে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে এ ধরনের তথ্য উঠে এসেছে। এতে করে ক্ষোভ জানিয়েছেন পিজির সদস্যরা। তারা বলছেন, কাজ আমাদের করার কথা ছিল। প্রকল্পের ডিজাইন অনুযায়ী অফিসের কর্তারা শেড তৈরি করে দেবেন এমন প্রতিশ্রুতিতে তারা কাজটি আমাদের করতে দেননি। এখন তারা নিম্নমানের কাঠ, ইট, পরিমাণে কম বালু ও সিমেন্ট দিয়ে নির্মাণ কাজ শেষ করেছেন। আমরা নিজেরা কাজ করলে এতো নরমাল হতো না। এখন আমরা মুরগি রাখতেও ভয় পাচ্ছি।

সর্বানন্দ ইউনিয়নের তালুক বাজিত গ্রামের পিজি সদস্য মোছা. মৌসুমী আক্তার বলেন, আমাদেরকে বলেছে যে, তোমাদের বিশ হাজার টাকা বাজেট আইচছে। এই হিসাবে আমরা স্বাক্ষর করেছি। আমাদের ঘরও উঠাই দিছে উনারা। বলছে বিশ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এটুকুই আমরা জানি। এখন কতো খরচ হলো তাতো জানি না।

তবে এ ঘর নির্মাণে বিশ হাজার টাকা খরচ হয়নি স্বীকার করে তিনি বলেন, এখানে মুরগি রাখা নিরাপদ নয়। সে কারণে রাতে রাখি না।

মৌসুমির স্বামী মো. মাইদুল ইসলাম বলেন, শুনেছি বিশ হাজার টাকা বাজেট। তবে এখানে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে আমার ধারণা। এখানে চড়াই রাখার কোনো পরিবেশ নেই। কারণ হাত দিয়ে টান দিলেই এগুলো খুলে আসে।

একই গ্রামের পিজি সদস্য মোছা. জুই আক্তার বলেন, ‘কাজ উমরায় কইরছে। হামাক খালি ৫০টা ইট আইনতে বলছে। ওমার বাড়ি থাকি আনি দিছি। মিস্ত্রি কাজ করেছে। আর আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র উমরায় আনিয়া উমরায় কাজ করি গেইছে। টাকা পয়সা হামার হাতোত দেয় নাই।’

তারাপুর ইউনিয়নের নিজাম খাঁ গ্রামের পিজি সদস্য মোছা. দুলালী বেগম বলেন, বরাদ্দ বিশ হাজার টাকা ছিল। ঘরটা আমাদের করার কথা ছিল। কিন্তু অফিস থাকি কাজ কইরছে। এ ঘরে মুরগি রাখার পর গাড়োয়া ঠ্যাং টানি নিয়া যায়। সেই কারণে জাল দিয়েছি। বৃষ্টিতে ভেজে সে কারণে পলিথিন দিয়ে দিতে হয়।

‘ওই ঘরে মুরগি রাখলে গাড়োয়া ঠ্যাং টানি নিয়া যায়’

এ বিষয়ে কথা হয় মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা বিপ্লব দেবের সঙ্গে। তিনি হরিপুর ইউনিয়নের লাইভস্টক সার্ভিস প্রোভাইডার (এলএসপি)।

তিনি বলেন, অফিস থেকে আমাদেরকে কাজের কোনো শিডিউল দেওয়া হয়নি। পার্শ্ববর্তী সাদুল্লাপুর উপজেলার ঘরগুলো দেখে আমি কাজ করেছি।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ইউএলও) মো. ফজলুল করিম বলেন, মুরগির শেডগুলো শিডিউল মোতাবেক করা হয়েছে। এতে কোনো ধরনের অনিয়ম করা হয়নি। আপনাদের সন্দেহ হলে জুডিসিয়ালি মাঠে গিয়ে দেখতে পারেন।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তরিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

গাইবান্ধা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার মো. মাহফুজার রহমান জাগো নিউজকে বলেন, শিডিউলের বাইরে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। অবশ্যই শিডিউল মোতাবেক কাজ করতে হবে। আমি দ্রুত মুরগির শেডগুলো পরিদর্শন করবো। অনিয়ম প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।