কাজ না পেয়ে ঋণের বোঝায় জর্জরিত হাজারো দিনমজুর

উপজেলা প্রতিনিধি উপজেলা প্রতিনিধি মিরসরাই (চট্টগ্রাম)
প্রকাশিত: ০৪:২০ পিএম, ১৪ অক্টোবর ২০২৩

ঘড়ির কাটা সকাল ৭টা ছুঁই ছুঁই। মিরসরাই-সীতাকুণ্ড সীমান্তবর্তী বড়দারোগাহাট বাজারে তখনো গুটিকয়েক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব বন্ধ। বাজারের একপাশে অনেক মানুষের জটলা। তারা সবাই বসে আছেন কাজের আশায়। বছরের পর বছর এমন সময়ে তারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে আসেন কাজের উদ্দেশ্যে। আসার এক-দু’দিনের মধ্যে তারা এখানকার কৃষকদের কাছে বিক্রি হয়ে যান। কিন্তু এবারের চিত্র উল্টো। টানা ৫-৭ দিন অপেক্ষা করার পরও এখনো কাজ মেলেনি অনেকের। ফলে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বিভিন্ন বাজারে এই সময়ে জমজমাট থাকে শ্রম বিক্রির হাট। দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে প্রতিদিন শত শত দরিদ্র মানুষ এখানে আসেন তাদের শ্রম বিক্রি করতে। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে উপজেলার বড়দারোগারহাট, মিঠাছড়া, বারইয়ারহাট বড়তাকিয়া, আবুতোরাব, আবুরহাটসহ বাজারগুলোতে জড়ো হন মানুষ। ফজরের আজান শোনার পর থেকে শ্রম বিক্রির হাটে মানুষ জড়ো হতে শুরু করেন।

আরেক শ্রেণির মানুষ আসেন শ্রমিক কিনতে। এসব শ্রমিকরা কৃষিকাজ থেকে শুরু করে গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজও করে থাকেন। তবে সবচেয়ে বেশি হাট জমে বড়দারোগাহাটে। প্রায় শত বছর ধরে এখানে শ্রম বিক্রি চলে আসছে।

প্রতিদিন সকাল হলেই চলতে থাকে শ্রমের দরদাম, যাকে বলা হয় বদলা। কেউ বলেন কামলা আবার কেউবা বলে থাকেন কাজের লোক। প্রতিদিন ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে মানুষের শ্রমের বাজার। এসব শ্রমিকরা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকেন।

এখানে এসে কাজ না পেলে এসব শ্রমিকরা বিভিন্ন স্কুল, মাদরাসা ও মসজিদের বারান্দায় রাত্রী যাপন করেন। পরেরদিন কাকাডাকা ভোরে আবার শুরু হয় তাদের শ্রম বিক্রি। এভাবে চলতে থাকে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর জীবিকা নির্বাহ। কেউ বিক্রি হন কৃষকের বাড়িতে। আবার কারো জায়গা হয় আগের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। তবে নিত্যপণ্যের দাম বেশি হওয়ায় আগের দামে শ্রম বিক্রি করলেও তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাদের। অনেকেই আবার ঋণে জর্জরিত।

কাজ না পেয়ে ঋণের বোঝায় জর্জরিত হাজারো দিনমজুর

হাটে গিয়ে কথা হয় নোয়াখালীর সুবর্ণচর থানার কাটাবনিয়া চরামূল্যায়ন কাটাবন এলাকার আব্দুল মালেকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ৫ দিন হয়েছে আমি এখানে এসেছি। তার মধ্যে ৫০০ টাকা মূল্যে তিনদিন কাজ করেছি। বাকি দুইদিন কেউ আসেনি নিতে। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছেলে-মেয়েসহ ৫ জন। বাড়িতে কী পাঠাবো, নিজে কী খাবো বুঝছি না। জিনিসপত্রের যে দাম তাতে পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি থানার গোড়না এলাকার আব্দুল আলিম বলেন, এক স্বজনের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা নিয়ে ৩ দিন আগে এখানে এসেছি কাজের জন্য। এখনো পর্যন্ত কেউ কাজে নিয়ে যায়নি। পরিবারে বৃদ্ধ মা-বাবাসহ সদস্য সংখ্যা ৬ জন। আয় রোজগার করার মতো আর কেউ নেই। পরিবারের খরচের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। সপ্তাহের প্রতি বুধবার ১ হাজার ৫০ টাকা করে দিতে হয়। বাড়ি থেকে স্ত্রী ফোন দিয়েছে ছেলের মাদরাসার খরচ, কিস্তি এবং এখানে আসার জন্য যে টাকা নিয়েছি তা দেওয়ার জন্য। কিন্তু কোথা থেকে দেবো, কী করে দেবো তা জানা নেই। সরকারের কাছে চাওয়া আমাদের যেকোনো একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।

বগুড়া জেলার শীবগঞ্জ থানার মো. আব্দুল লতিফ বলেন, এলাকার এক স্বজনের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা নিয়ে গত ১৫ দিন আগে মিরসরাইয়ে এসেছি শ্রম বিক্রি করে টাকা আয় করার জন্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো মাত্র ৮ দিন কাজ করেছি ৫০০ টাকা মূল্যে। বাকি দিনগুলো বসে বসে খাচ্ছি। পকেটের অবস্থাও খারাপ। আজ যদি কেউ না নিয়ে যায় রাতে না খেয়ে থাকতে হবে।

কাজ না পেয়ে ঋণের বোঝায় জর্জরিত হাজারো দিনমজুর

লতিফ আরও বলেন, ৮ দিন কাজ করে যা পেয়েছি তার মধ্যে সবেমাত্র ২ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠিয়েছি। পরিবারে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও মাসহ সদস্য সংখ্যা ৪ জন। এরমধ্যে আশা এনজিওতে ১২০০ টাকা এবং গ্রামীণ ব্যাংকে ৮৫০ টাকাসহ প্রতি সপ্তাহে ২ হাজার ৫০ টাকা কিস্তি দিতে হয়। নিজে খাবো, বাড়িতে দেবো, নাকি কিস্তির টাকা শোধ করবো কিছুই বুঝছি না। দেশে জিনিসপত্রের যে হারে দাম বেড়ে চলেছে, বেঁচে থাকাই কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে।

বড়দারোগাহাট বাজারের স্থানীয় প্রবীণ ব্যবসায়ী রুহুল আমিন সওদাগর জাগো নিউজকে বলেন, আমি এ বাজারে ৫০ বছর ধরে ব্যবসা করছি। তখন থেকে দেখছি এই মৌসুমে বিভিন্ন জেলার লোকজন এখানে কৃষিকাজ করতে আসেন। আমার বাবার আমল থেকে এখানে শ্রম বিক্রি হয়ে আসছে। তবে এবারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। এক সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করেও অনেক শ্রমিক কাজ পায়নি।

এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।