এক রাতের বৃষ্টিতে ডুবেছে ময়মনসিংহ নগরী

মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জুরুল ইসলাম ময়মনসিংহ
প্রকাশিত: ১২:৩৪ পিএম, ০৬ অক্টোবর ২০২৩

## বেশকিছু এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন
## ঘরে ঘরে হাঁটু থেকে কোমর পানি
## তলিয়েছে ধানক্ষেত, ভেসে গেছে পুকুর-ঘেরের মাছ

পুরো এক রাতের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ময়মনসিংহ নগরীর রাস্তাঘাট। পানি উঠেছে বাসাবাড়ি ও দোকানে। বাসায় পানি ওঠায় অনেকের রাত কেটেছে নির্ঘুম। নগরী ব্রাহ্মপল্লী এলাকায় বাসার হাঁটু পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা গেছেন পলি (৬৫) নামে এক বৃদ্ধ।

এছাড়া উপজেলায় তলিয়ে গেছে ধানক্ষেত। ভেসে গেছে পুকুর-ঘেরের মাছ। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার (৬ অক্টোবর) ভোর ৪টা পর্যন্ত টানা ভারী বর্ষণ হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ময়মনসিংহ নগরীর গাঙ্গিনারপাড়, ধোপাখলা, চরপাড়া, নতুন বাজার, স্টেশন রোড, নয়াপাড়া, ব্রাহ্মপল্লী, কালিবাড়ি, গুলকিবাড়ি, আমলাপাড়া, ভাটিকাশর৷ কালিবাড়িসহ নগরীর অনেক এলাকা হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি জমেছে। এসব এলাকার বাসাবাড়ি ও দোকানে পানি উঠেছে। অনেক পরিবার নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। নগরীর বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে।

নগরীর ব্রাহ্মপল্লী এলাকায় আটকে পড়া ইমরুল হাসান ইমন বলেন, ভাবি অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার জন্য বাসা থেকে খাবার আনতে শিকারিকান্দা এলাকায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হাঁটুসমান পানিতে আটকা পড়েছি। বৃষ্টিতে সড়কে গাড়িও চলছে না।

Mymensingh-(6).jpg

নগরীর গোলাপজান রোড এলাকায় একটি ছাত্রাবাসে থাকেন আনন্দমোহন কলেজের শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান। সেখানে পানি ওঠায় বিপাকে পড়েছেন তিনি। এমন অবস্থা পুরো নগরজুড়েই।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক জাকিউল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, হাসপাতাল চত্বরের কিছু এলাকা নিচু হওয়ায় পানি ঢুকে পড়েছে। স্টাফ কোয়ার্টারগুলোর নিচতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। গতরাতে বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটর দিয়ে চিকিৎসাসেবা চালু রাখা ছিল। তবে সকাল থেকে বিকল্প বিদ্যুৎ লাইনে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা চালু আছে।

রেলওয়ের পরিবহন বিভাগের পরিদর্শক শাহীনুর ইসলাম বলেন, রেলপথ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সিগন্যাল পয়েন্ট কাজ করছে না। ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেন চলাচল বিঘ্ন হচ্ছে।

এদিকে, রাত ১০টার দিকে ময়মনসিংহ নগরীর কেওয়াটখালী এলাকার পাওয়ার গ্রিডের কন্ট্রোল রুমে পানি ঢুকে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তিন ঘণ্টায় কন্ট্রোল রুমের পানি সেচে বের করেন। এ ঘটনায় বেশ কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। রাত ২টার পর আবার কন্ট্রোল রুমে পানি জমে কেওয়াটখালী পাওয়ার গ্রিড বন্ধ আছে। এতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছে নগরীর বেশ কিছু এলাকা।

jagonews24

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ ফায়ার স্টেশন কর্মকর্তা জুলহাস উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, রাত ১০টার দিকে কেওয়াটখালী পাওয়ার গ্রিড থেকে খবর আসে কন্ট্রোল রুমে পানি ঢুকেছে। এমন খবর পেয়ে তিন ঘণ্টা সেচে পানি সরানো হয়। রাতে আবারও কন্ট্রোল রুমে পানি ঢুকেছে শুনেছি।

ময়মনসিংহ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (দক্ষিণ) নির্বাহী প্রকৌশলী ইন্দ্রজিৎ দেবনাথ জাগো নিউজকে বলেন, অতি বৃষ্টির কারণে কেওয়াটখালী পাওয়ার গ্রিড়ের কন্ট্রোল রুমে পানি ঢুকে বন্ধ আছে। এতে নগরীর স্টেশন রোড, পাদ্রী মিশন, চরপাড়াসহ বেশকিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছে। ঠিক হতে কত সময় লাগবে তা এখন বলা যাচ্ছে না।

সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের চর ঈশ্বরদিয়া এলাকায় অন্তত ৫০০ একর ধানক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। ওই এলাকার কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, আমি আট কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। গতরাতের বৃষ্টির পানিতে সব তলিয়ে গেছে।

একই এলাকার নেকবর মিয়া বলেন, আমি চার কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার সব পানিতে তলিয়ে গেছে।

Mymensingh-(6).jpg

সদর উপজেলার চর হরিপুর এলাকার বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, ১০ শতাংশের পুকুর ডুবে সব মাছ ভেসে গেছে। পুকুরে ৫০ হাজার টাকার মাছ ছিল।

একই এলাকার শামীম আহমেদ বলেন, আমার প্রায় ৩০ কাঠা ধানি জমি তলিয়ে গেছে। তবে, আমার কোনো ফিসারি না থাকায় বেঁচে গেছি। এ গ্রামে অন্তত ৩০০ একর জমির ধান তলিয়ে গেছে। বাড়িঘরেও পানি উঠেছে।

একই এলাকার আব্দুর রহিম বলেন, বাড়ির চারপাশে অপরিকল্পিত পুকুর ও ফিসারি। এই কারণে বাড়ি ঘরে পানি উঠে গেছে। গরু-ছাগল নিয়ে বিপাকে আছি। রান্নাঘরে পানি ওঠায় খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।

লিপি আক্তার বলেন, এক রাতের বৃষ্টিতেই বাড়ি ঘর তলিয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে খুব বিপদে আছি। চারপাশে অপরিকল্পিত ফিসারির কারণে আজ আমাদের এই দুর্দশা।

চর হরিপুর এলাকার জয়নাল বলেন, ১৭ কাঠা জমি লিজে নিয়ে ফিসারি দিয়েছি। এক রাতের বৃষ্টিতে সব ফিসারি তলিয়ে গেছে। মাছ যেন ফিসারি থেকে না যেতে পারে তাই নেটজাল দিচ্ছি। আমার অন্তত ১৫ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে।

চর হরিপুর মজিবুর রহমান বলেন, এমন বৃষ্টি দেখছি বহুবার কিন্তু এভাবে পানি জমতে দেখিনি কখনো। আমার ১০ কাঠা ধানের জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে ১২ কাঠা জমিতে ফিসারি ছিল। সব ফিসারি তলিয়ে গেছে। আমার অন্তত ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার মাছ চলে গেছে।

jagonews24

একই এলাকার মরম আলী বলেন, আমার ১৭ কাঠা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ১৫ কাঠা ফিসারির মাছ ভেসে গেছে। চর হরিপুর, বাজিতপুর ও আলালপুর গ্রামে অন্তত হাজার একর ফিসারি তলিয়ে গেছে।

জেলার গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের কাঠবাড়ি এলাকার এরশাদুল বলেন, এক রাতের বৃষ্টিতে আমার এক কাঠা মেহগনি গাছের বাগান ভেসে চলে গেছে। একটা ফিসারিতে দুই লাখ টাকার মাছ ছিল। তাও ভেসে গেছে।

গফরগাঁও পৌর শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ১ ও ২ নম্বর গলির বেশিরভাগ বাসাবাড়িতে পানি ঢুকেছে। পৌরশহরের প্রতি ওয়ার্ডে কম বেশি রাস্তার ওপরে পানি উঠেছে। এছাড়া উপজেলার অনেক এলাকার ফিসারির মাছ ভেসে গেছে পানিতে। ধানি জমিতেও পানি জমেছে।

ওই উপজেলার চরআলগী ইউনিয়নের চর কামারিয়া নদীর পাড়ে এক মাস আগে ছোট ব্রিজ তৈরি করা হয়েছিল। যা গত রাতের বৃষ্টিতে ভেসে গেছে। এতে স্থানীয়দের চলাচলের বিঘ্ন ঘটছে।

jagonews24

এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মতিউজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, জেলার সব উপজেলায় ধানক্ষেত তলিয়ে গেছে। তবে পরিমাণ ধানক্ষেত তলিয়েছে তার কোনো হিসাব এখনো করা হয়নি। পানি নেমে গেলে হিসাব করা যাবে।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু জাগো নিউজকে বলেন, বৃষ্টি কিছুটা কমায় পানিও কমতে শুরু করেছে। দ্রুত পানি সরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে একটি টিম কাজ করছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজার রহমান জাগো নিউজকে বলেন, গত রাতের বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষিরা। ১৩ উপজেলায় প্রচুর ফিসারি তলিয়ে মাছ ভেসে গেছে। এছাড়া প্রতি উপজেলায় অনেক ধানক্ষেত তলিয়ে গেছে। ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে হিসাব সংগ্রহ করছি। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসজে/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।