পর্যটন মেলা
কক্সবাজারে নন-স্টার হোটেলে ছাড় নিয়ে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’
বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে কক্সবাজারে চলছে সাতদিনের পর্যটন মেলা ও বিচ কার্নিভাল। মেলা চলাকালে পর্যটন জোনের আবাসিক হোটেল ভাড়ায় ৫০-৬০ শতাংশ ছাড় ঘোষণা করা হলেও তারকা হোটেলগুলো ছাড়া নন-স্টার হোটেলগুলো বাস্তবে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পর্যটকদের। তারকা হোটেলগুলো সরাসরি হোটেলে গেলে ৫০ শতাংশ আর মেলার স্টলে গিয়ে রুম ভাড়া নিলে ৬০ শতাংশ ছাড় দিচ্ছে। কিন্তু নরমাল হোটেল ও গেস্ট হাউজ কর্তৃপক্ষ অতিথিদের কাছ থেকে কম ভাড়াতো দূরে থাক স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বেশি ভাড়া আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাই মেলা উপলক্ষে হোটেল ভাড়ায় ছাড় ঘোষণা পর্যটকদের সঙ্গে একটি বড় ‘ধাপ্পাবাজি’ বলে মনে করছেন পর্যটকরা।
তথ্য মতে, কক্সবাজারে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত ছয় মাস শীতকালীন পর্যটন মৌসুম এবং বাকি সময়টুকু অফসিজন হিসেবে ধরা হয়। আবার বছরের শেষ সময়ে যখন শীত বেশি পড়ে, তখন পর্যটক বেশি আসে বলে ওই সময়কে ধরা হয় ‘পিক সিজন’। পিক সিজনে হোটেল ভাড়ায় বিশেষ কোনো ছাড় পাওয়া না গেলেও অফ সিজনে এমনিতেই ৫০-৬০ শতাংশ বা তারও বেশি ছাড় পাওয়া যায়। বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া সাত দিনব্যাপী পর্যটন মেলা ও বিচ কার্নিভাল চলাকালেও একই পরিমাণ ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে আগে থেকেই।
তবে পর্যটকদের অভিযোগ, মেলা উপলক্ষে হোটেল মালিকরা পর্যটকদের কাছ থেকে কম ভাড়াতো দূরে থাক আরও বেশি ভাড়া দাবি করছে।
কক্সবাজারে বেড়াতে আসা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গবেষণার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ ২৭ তারিখ থেকে ৪ দিনের জন্য কক্সবাজারে এসেছি। আমাদের জন্য কয়েকটি নন তারকা হোটেলে রুম ভাড়া চাওয়া হয়েছিল। টুইন বেডের (দুইটি খাটের) একেকটি নন-এসি কক্ষের ভাড়া দাবি করা হয় এক হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। অথচ পিক সিজনেও এই ভাড়ায় কক্সবাজারে এসব হোটেল কক্ষ ভাড়া পাওয়া যায়। এখন বাধ্য হয়ে রুম প্রতি ১৮০০ টাকায় থাকছি। তবে কোন হোটেলে উঠেছেন তার নাম জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
এক বিচকর্মী জানান, পর্যটন মেলা ও বিচ কার্নিভাল উপলক্ষে আমার এক আত্মীয় কক্সবাজারে বেড়াতে আসার কথা বলায় তার জন্য লাবণী পয়েন্টের একটি হোটেলে কক্ষ বুকিং করতে গিয়ে এক কক্ষের ভাড়া চাওয়া হয় দুই হাজার টাকা।
এনজিওকর্মী এনামুল হক জানান, পর্যটন মেলা উপলক্ষে তার কিছু পরিচিত ব্যক্তি ৩ দিনের জন্য কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছেন। তাদের থাকার জন্য লাইট হাউস এলাকা ও কলাতলী মোড়ের গলির ভেতরের কয়েকটি হোটেলে কক্ষ ভাড়া চেয়েছিলাম। দুই খাটের নন-এসি কক্ষের ভাড়া দাবি করা হয়েছে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।
তিনি প্রশ্ন করেন, ৬০ শতাংশ ছাড়ের পর যদি এই ভাড়া হয় তাহলে ওই কক্ষের আসল ভাড়া কত?
কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ হোটেল-রিসোর্টস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, দৈনিক একটি কক্ষের পেছনে খরচ আসে ৭০০ টাকা। এখন সবকিছুর দাম বেড়েছে।
পর্যটন মৌসুমে টুইন বেডের নন-এসি একটি রুমের ভাড়া ৪ হাজার ৫০০ টাকা বা ৪ হাজার টাকা নেওয়া হয় কিনা জানতে চায়লে কোনো উত্তর দেননি তিনি।
সরকারি কর্মজীবী সমীর রঞ্জন সাহা বলেন, পর্যটন মেলা বলে নয়, সপ্তাহিক মিলিয়ে টানা তিনদিন বা তার বেশি বন্ধ পাওয়া গেলে কক্সবাজারে পর্যটক সমাগম বেড়ে যায়। ঈদ-এ- মিলাদুন্নবী ও সপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে তিনদিনের ছুটি পড়ায় অনেক আগেই ‘ওয়ান থেকে ফাইভ স্টার’ মেইনটেইন করা হোটেল কক্ষ বুকিং হয়ে যায়। এক কাছের বন্ধু পরিবার নিয়ে শুক্র-শনিবার বেড়াতে কক্সবাজার আসতে চাওয়ায় রুম না পেয়ে নন-স্টার হোটেলে রুম দেখেছি। তিন থেকে ৬ হাজার টাকা দাবি করেছে। অনেক কষ্টে তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইসে একটি রুম ম্যানেজ হয়েছে। এত ক্রাইসিসেও এরা ঘোষণা মতো ৫০ শতাংশ ছাড় দিয়েছে। কিন্তু ছাড়ের ঘোষণায় নন-স্টার হোটেলগুলো ধাপ্পাবাজি করছে।
কলাতলীর হোটেল-মোটেল জোন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নন-স্টার একাধিক হোটেলে যার কাছে যা পাচ্ছে তাই ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় গোপন রেখে যোগাযোগ করা হলে একটি হোটেলে দুই হাজার, কোনো কোনো হোটেলে তিন হাজার আবার কোনো হোটেল ৫ হাজার টাকা ভাড়া চায়।
মেলা উপলক্ষে ছাড়ের কথা বলা হলে তারা জানায়, ২৭ তারিখ একদিনের জন্য তারা এটি পালন করেছে।
হোটেল বিচওয়ের ম্যানেজার মিজান বলেন, আগে যারা বুকিং দিয়েছিল তাদের কিছু ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়েছিল। এখন কোনো ডিসকাউন্ট দেওয়া হচ্ছে না।
সিলভার বে মেরিনার ফ্রন্ট ডেস্ক কর্মকর্তা মোস্তফা বলেন, ২৭ সেপ্টেম্বর একদিন আমরা ডিসকাউন্ট দিয়েছি। এখন আর নেই। আমরা আমাদের নিয়মে রুম দিচ্ছি।
শুধু ভাড়া নিয়ে প্রতারণা তা নয়, মেলার স্টল ও মঞ্চ এলাকা ছাড়া পর্যটন নগরীর কোথাও বর্ণিল সাজ নেই সৈকতে। বরং বেলাভূমিতে ঝুঁপড়ির বস্তি রেখে পর্যটন মেলা নিয়ে প্রচারণা চালানোয় হাসিঠাট্টা করছেন পর্যটক ও দর্শণার্থীরা।
লাবণী ও সুগন্ধা পয়েন্ট সৈকত এলাকায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০২২ সালের ৯ নভেম্বর যেসব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল তা সৈকতে আবারও শোভা পাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, জেলা প্রশাসনকে রাজস্ব দিয়ে ব্যবসা করছেন তারা। বিচকর্মী নামে কিছু লোক এখান থেকে টাকাও তুলছেন। এসব ঝুপড়ি সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট করার পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রতিবেশেরও ক্ষতি করছে।
আর পর্যটন মেলা উপলক্ষে ছোটবড় সব দোকান এবং হোটেল-মোটেল থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়েছে জেলা প্রশাসন। তারপরও সৈকত ও পর্যটন এলাকা শ্রীহীন করে রাখায় প্রশ্ন তুলেছেন সবাই।
কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, চার শতাধিক হোটেল-গেস্ট হাউজ রয়েছে এখানে। কিন্তু সবাই আমাদের সংগঠনভুক্ত নয়৷ আমরা প্রশাসনকে দেওয়া কথা রাখছি। বাকিদের কথা আমরা জানি না।
কক্সবাজার পর্যটন মেলার আহ্বায়ক ও জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, অভিযোগ আমাদের কাছেও আসছে। যেসব হোটেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরইমধ্যে আমাদের কয়েকটি টিম তদন্তে বেরিয়েছে।
এফএ/এমএস