দিনে ৪ ঘণ্টা চা বেচে মাসে আয় ২০ হাজার
জীবনটা ঠিক যেন এক কাপ চায়ের মতো, তার স্বাদ ঠিক তেমনটাই হবে যেমনটা আপনি সেটিকে বানাবেন। এসব প্রবাদকেও হার মানায় আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া নিত্যনতুন সব গল্প। এই চা হয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার প্রিয় মুহূর্ত, আবার কখনো বা বেকার যুবকের সচ্ছল হওয়ার স্বপ্ন।
হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এই চা বেচে স্বপ্ন বুনছেন মেহেদী হাসান (২২) নামের এক যুবক। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ডেলিভারির চাকরি শেষে নেমে পড়েন চা বানানোর কাজে। এক হাতেই সামলাচ্ছেন নিজের তৈরি করা স্বপ্নের ছোট্ট চায়ের দোকানটি। তবে ছোট হলেও বেশ সুনাম রয়েছে তার জাদুকরী হাতে বানানো চায়ের। তার দোকানেই মেলে ৯ রকমের চা। প্রতিটি চায়ের আলাদা আলাদা স্বাদ যেন আপনাকে দেবে দারুণ তৃপ্তি। এরই মধ্যে তার বানানো চা প্রশংসা কুড়চ্ছে জেলা শহরের চাপ্রেমীদের কাছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেহেদী হাসান শরীয়তপুর পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের স্বর্ণঘোষ এলাকার আলী আকবর তালুকদারের ছেলে। মাত্র ছয় বছর বয়সেই তাকে রেখে জীবিকার তাগিদে সৌদি আরবে পাড়ি জমান তার মা পারভীন বেগম। এরপর আর তেমন যোগাযোগ রাখেননি পরিবারের সঙ্গে। খুব ছোট থেকেই শহরের সৌদিয়ান মার্কেটে বাবার চায়ের দোকান সামলানো শুরু করেন মেহেদী। তখন থেকেই রপ্ত করে নেন চা বানানোর নানা কৌশল। বাবার ব্যবসা সামলানোর পাশাপাশি ২০১৭ সালে শরীয়তপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে মাধ্যমিক ও ২০১৯ সালে শরীয়তপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন এ যুবক।
আরও পড়ুন: ‘১০০ টেকার স্যালাইন কিনলাম চারশ টেকা দিয়া’
তবে বাবার ছায়াটুকুও হারান যখন ঘরে সৎমা আসেন। বাধ্য হয়ে ২০২২ সালের প্রথম দিকে ঘর ছেড়ে চলে যান পৌরসভার নিরালা এলাকায়। সেখানে যাওয়ার পর বিপাকে পড়ে যান মেহেদী হাসান। পরে এক বন্ধুর মাধ্যমে ১১ হাজার টাকার বিনিময়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একটি কোম্পানির মালামাল ডেলিভারির কাজ শুরু করেন তিনি। তবে তার মন পড়ে থাকে বাবার সেই ছোট্ট চায়ের দোকানে। তারপর নিজের চেষ্টায় ও চাকরির জমানো টাকা বাঁচিয়ে পালং স্কুল রোডে তিন হাজার টাকার একটি দোকান ভাড়া নিয়ে শুরু করেন চায়ের ব্যবসা। স্বাদে ভিন্নতা আনতে তৈরি করেন নানা ধরনের চা। আর এতেই সফল মেহেদী হাসান। তার দোকানের চায়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে জেলার বিভিন্ন জায়গায়। তার এ চা খেতে প্রতিদিনই দোকানে ছুটে আসছেন নানা শ্রেণি-পেশার লোকজন। চা খেতে খেতে আড্ডায় মেতে ওঠেন তারা।
মেহেদী হাসান জানান, গরম পানি, চা পাতা, তেঁতুল, লেবু, চাল ভাজা, বাদামগুঁড়া, দুধের সর, গুঁড়াদুধ, চকলেটের গুঁড়াসহ অন্তত ১০ ধরনের বিভিন্ন মসলা দিয়ে ৯ ধরনের চা তৈরি করে থাকেন। এছাড়া তার দোকানে চার ধরনের কফি ও লেবুর পিনিক পাওয়া যায়। রং চা ৫ টাকা, মসলা রং চা ১০ টাকা, চাল ভাজার রং চা ১০ টাকা, তেঁতুল চা ২৫ টাকা, লেবু চা ১০ টাকা, দুধ চা ১৫ টাকা, মসলা দুধ চা ২০ টাকা, মালাই চা ২০ টাকা, ড্রাগন চা ২০ টাকা, নরমাল কফি ২৫ টাকা, ইমোজি কফি ৩৫ টাকা, লেটার কফি ৩৫ টাকা, ব্লাক কফি ১০ টাকা আর লেবুর পিনিক বিক্রি করা হয় ৩০ টাকা।
আরও পড়ুন: পাটে লোকসান, কাঠিতে স্বপ্ন বুনছেন কৃষকরা
মেহেদী হাসান বলেন, বাসা থেকে চলে আসার পর খুবই কষ্টে আমার দিন কেটেছে। তবে আমি হাল ছাড়িনি। যেহেতু হাতে টাকা-পয়সা ছিল না তাই প্রথমে ছোট একটা চাকরি শুরু করি। পরে টাকা জমিয়ে এই দোকানটি দেই। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একটি কোম্পানির মালামাল ডেলিভারি দিয়ে বিকেল ৫টা থেকে ৯টা পর্যন্ত মোট চার ঘণ্টা দোকান করি। দোকানে প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ কাপ চা বিক্রি হয়। এ থেকে মাসে ২০ হাজার টাকা লাভ করি। এ দিয়ে আমার সংসার বেশ ভালোই যাচ্ছে। ইচ্ছে আছে টাকা জমিয়ে দোকানটি আরও বড় করবো।
শহরের কোটাপাড়া এলাকা থেকে আসা শ্যাম তালুকদার বলেন, কয়েক মাস আগে এক বন্ধুর মাধ্যমে এই দোকানের সন্ধান পাই। এখন আমি নিয়মিত এখানে চা খেতে আসি। মেহেদীর দোকানের মালাই চা আমার ভীষণ পছন্দের। আমার বন্ধুরাও ওর দোকানের মালাই চা ভীষণ পছন্দ করে। মেহেদীর এই চায়ের দোকানের জন্যই বিকেল হলে জায়গাটা খুব জমে ওঠে।
সদর উপজেলার ধানুকা থেকে হামজা রাজ, রেদোয়ান আহম্মেদ ও রূপক শেখ নামের তিন বন্ধু এসেছেন মেহেদী হাসানের দোকানের লেবুর পিনিক খেতে। এদের মধ্যে হামজা রাজ জানান, তারা বন্ধুরা মাঝে মধ্যেই মেহেদীর দোকানের লেবুর পিনিক খেতে আসেন। এখানে লেবুর সঙ্গে একধরনের স্পাইসি মসলা ব্যবহার করা হয়। যা খুবই মজার।
আরও পড়ুন: সকালে রোগীর চাপ সামলানো দায়, বিকেলে অলস সময় পার করছেন চিকিৎসকরা
টিপু কোতোয়াল নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, মেহেদীর দোকানের নানা ধরনের চা খেতে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন লোকজন আসে। এমনকি আমার বন্ধুরা বা আত্মীয়-স্বজন কেউ বাড়িতে বেড়াতে আসে মেহেদীর দোকানের চা পান করাই। সবাই মেহেদীর দোকানের চায়ের খুব প্রশংসা করেছে।
শরীয়তপুর পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর ব্যাপারী বলেন, মেহেদী নামের ওই ছেলেটি চায়ের দোকান দিয়ে কয়েক রকমের চা তৈরি করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। ওর দোকানে বিভিন্ন স্বাদের চা পাওয়া যায়। বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জেলা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন ওর চায়ের দোকানে চা খেতে আসে। এত কম বয়সেই মেহেদী চা বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছে, বিষয়টি সত্যিই প্রশংসনীয়।
জেএস/জেআইএম