জিআই স্বীকৃতি চায় সরিষাবাড়ীর প্যাঁরা সন্দেশ

নাসিম উদ্দিন নাসিম উদ্দিন , জেলা প্রতিনিধি, জামালপুর
প্রকাশিত: ০৫:৩৪ পিএম, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির খাদ্যতালিকায় মিষ্টি ও মিষ্টি জাতীয় খাবারের গুরুত্ব অনেক বেশি। যেকোনো শুভ সংবাদে মিষ্টি বিতরণ বাঙালির চিরকালীন প্রথা। আর এসব মিষ্টির ভিড়ে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার ‘প্যাঁরা সন্দেশ’।

গরুর খাঁটি দুধের ঘন ক্ষীর এবং চিনির মিশ্রণে তৈরি হওয়া এই মিষ্টির স্বাদ অন্য মিষ্টির চেয়ে একটু আলাদা ও সুস্বাদু। শুকনো হওয়ায় দূর-দূরান্তে বহনেও বেশ সুবিধা। আর এজন্যই মানুষের কাছে রসালো মিষ্টির চেয়ে এই মিষ্টি পছন্দের। উপজেলায় অনেক মিষ্টির দোকান থাকলেও কালাচাঁদ মিষ্টান্ন ভান্ডার, মধু মিষ্টান্ন ভান্ডার, বর্ধন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ও সংগীতা মিষ্টান্ন ভান্ডারে তৈরি হওয়া ‘প্যাঁরা সন্দেশ’ স্বাদে অতুলনীয়।

উপজেলার অধিকাংশ মিষ্টি ব্যবসায়ী জানান, সরিষাবাড়ীতে এসেছেন আর প্যাঁরার স্বাদ নেননি এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। এটি এ অঞ্চলের গর্ব। বাপ-দাদার আমল থেকেই তারা এটি তৈরি করছেন। হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দুধের ক্ষীর এবং আখের রসের মিশ্রণে এক ধরনের মিষ্টান্ন তৈরি হতো। সেই থেকে ধীরে ধীরে প্যাঁরা সন্দেশ বা মিষ্টিতে রূপান্তর হয়। এটি তৈরিতে পরিশ্রম বেশি হলেও ব্যাপক চাহিদা থাকায় উপজেলার প্রত্যেকটি মিষ্টির দোকানে এটি পাওয়া যায়। বর্তমানে এই প্যাঁরা সন্দেশ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে বলেও দাবি এসব ব্যবসায়ীদের।

সরিষাবাড়ীর বাসিন্দা মো. রাশেদ মোশাররফ। সবসময় প্যাঁরা সন্দেশের ভক্ত তিনি। শুধু তিনি নন, তার পরিবারের সকলেই এই সন্দেশ খেতে খুব পছন্দ করেন। কথা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্যাঁরা সন্দেশ স্বাদে, মানে ও গুণে অতুলনীয়। এটি শুকনা থাকায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। বগুড়ার দই যেমন দুধ থেকে তৈরি তেমনি সরিষাবাড়ীর প্যাঁরা সন্দেশও দুধ থেকেই তৈরি। সম্প্রতি বগুড়ার দইকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তেমনিভাবে আমরা সরিষাবাড়ীবাসীও চাই সরিষাবাড়ীর এই ঐতিহ্যবাহী প্যাঁরা সন্দেশকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।

বর্ধন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে কথা হয় ফুয়াদ হাসান নামে এক ক্রেতার সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সরিষাবাড়ীতে এলেই পরিবারের জন্য এই বিখ্যাত প্যাঁরা সন্দেশ নিয়ে যাই। কেননা পরিবারের খুবই প্রিয় এই সুস্বাদু খাবার। বিশেষ করে শিশুরা খুবই পছন্দ করে এই মিষ্টি। আমরা চাই বিখ্যাত এই প্যাঁরা সন্দেশের সুনাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ুক।

উপজেলার শিমলাবাজারের কাঁলাচাদ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্বত্তাধিকারী সুমন ঘোষ জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিদিন তার দোকানে বিভিন্ন রকম মিষ্টি তৈরি হলেও সবার চাহিদা প্যাঁরা সন্দেশ। এটি এই অঞ্চলের ঐতিহ্য। প্রতিদিন তার দোকানে গড়ে ৮০-১০০ কেজি প্যাঁরা সন্দেশ তৈরি হয়। নিজ উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে ময়মনসিংহ, শেরপুর, টাঙ্গাইল ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানেই এই প্যাঁরা সন্দেশ সরবরাহ করে থাকেন তিনি।

তিনি আরও জানান, তার দোকানের প্যাঁরা সন্দেশ আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইতালি, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, দুবাই প্রভৃতি দেশসমূহে অবস্থানরত প্রবাসীদের কাছে সরবরাহ হয়ে থাকে। শুকনো পাত্রে দেড় থেকে দুই মাস সংগ্রহ করে খাওয়া যায় বলে বিদেশে থাকা এই অঞ্চলের মানুষের কাছে প্যাঁরার কদর একটু বেশি।

এই মিষ্টির সবটুকুই দুধের ওপর নির্ভর করতে হয় বলে অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় দামও একটু বেশি হয়ে থাকে। একসময় ৩০০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে ১ কেজি প্যাঁরা সন্দেশ বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকা দরে। ৪০-৪৫টি প্যাঁরায় এক কেজি ওজন হয়ে থাকে।

মিষ্টির কারিগর চন্দন পাল ৩০ বছর যাবত এই প্যাঁরা সন্দেশ তৈরির সঙ্গে জড়িত। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বাইরে থেকে দেখে প্যাঁরা সন্দেশ বানানো সহজ মনে হলেও ততোটা সহজ নয়। দুধের ক্ষীর তৈরি করে তাতে চিনি ও ক্ষীরের মিশ্রণের একটা সঠিক অনুপাত প্রয়োজন হয়। আর এই অনুপাতের তারতম্য ঘটলে এর স্বাদ ও গুণগত মান দুটোই নষ্ট হয়ে যায়।

কারিগর হিসেবে দেশের অনেক অঞ্চলের প্রসিদ্ধ মিষ্টির স্বাদ গ্রহণ করলেও সরিষাবাড়ীর প্যাঁরা সন্দেশের স্বাদ দেশের অন্য অঞ্চলের মিষ্টির চেয়ে সেরা বলে তিনি দাবি করেন।

জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আব্দুল হাই আল হাদী জাগো নিউজকে বলেন, দেশের প্রত্যেক এলাকায় বিশেষ ধরনের মিষ্টি তৈরি হয়। যেমন নাটোরের কাঁচাগোল্লা, বিক্রমপুরের মিষ্টি-দধি, বগুড়ার দই, কুমিল্লার রসমালাই। তেমনি জামালপুরেও মিষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষত্ব থাকলেও প্রচার প্রচারণার অভাবে এটি পরিচিতি পায়নি। জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার প্যাঁরা সন্দেশ বেশ প্রসিদ্ধ। তবে নাটোর, কুমিল্লা, বগুড়া, বিক্রমপুরের মতো এতো পরিচিতি লাভ করতে পারেনি। এটার একটাই কারণ, জামালপুর জেলার সঙ্গে আন্তঃজেলার সংযোগ খুব কম। জামালপুর হয়ে খুব কম জেলার লোক যাতায়াত করে। এইজন্য এই জেলার মিষ্টি প্রসিদ্ধ হওয়া স্বত্তেও পরিচিতি পায়নি। তাই তিনি মনে করেন, যেখানে অন্য জেলার সঙ্গে যাতায়াতের রাস্তা রয়েছে সেখানে যদি এই প্যারা মিষ্টির শোরুম করা যায় তাহলে এর পরিচিতি বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও টিভি, পত্র-পত্রিকায় যদি প্রচারণা করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে বগুড়ার দইয়ের মতো জিআই পণ্য হিসেবে খুব সহজে স্বীকৃতি লাভ করবে সরিষাবাড়ীর এই প্যাঁরা সন্দেশ।

এফএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।