গরিবের প্লট বরাদ্দ পেলেন ধনাঢ্যরা
বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) উত্তর কাউনিয়া এলাকায় স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য বরাদ্দ আবাসন প্রকল্পের প্লট পেয়েছেন নগরীর ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও। এদের অনেকের নামে নগরীতে একাধিক বহুতল বাড়ি ও সম্পত্তি রয়েছে। অনেকে আবার নিজেদের নামে ছাড়াও প্লট নিয়েছেন স্ত্রী-সন্তানের জন্য। এই তালিকায় রয়েছেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতা, বিসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠকরা।
আবেদন ফরমে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, আবেদনকারীর নিজ নামে, উত্তরাধিকার সূত্রে অথবা ক্রয় সূত্রে নগরীতে কোনো জায়গা-জমি বা ভবন থাকতে পারবে না। অথচ বরিশাল সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কাউনিয়া হাউজিং প্রকল্প-২ এ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর স্ত্রী ও ছেলের নামে দুটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। নগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নিউ ভাটিখানা এলাকায় জাহাঙ্গীরের নিজস্ব চারতলা ভবন আছে।
আরও পড়ুন: দৃশ্যমান উন্নয়ন করতে পারিনি, তবে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না: সাদিক
প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের সাবেক ধর্মবিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম ও তার ছেলে বিসিসির পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক মো. আনজুম। অথচ শহীদ আরজু মনি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়-সংলগ্ন বরাদ্দ প্লটের পাশেই আছে নজরুল ইসলামের নিজস্ব বসতবাড়ি।
স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এ প্লট বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন নগরীতে ধনাঢ্য হিসেবে পরিচিতরা। এক্ষেত্রে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার আবেদনে যেসব নিয়মাবলী উল্লেখ করা হয়েছিল তার কিছুই মানা হয়নি।
জানা যায়, দল এবং বিসিসির যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী গত পাঁচ বছরে সাদিক আবদুল্লাহর কর্মকাণ্ড অন্ধের মতো সমর্থন করে গেছেন, তারাই বিদায়ের আগে মেয়রের শেষ পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন এ প্লট। তবে এসব প্লটের অধিগ্রহণ করা জমির উত্তরাধিকাররা রিট করায় হাইকোর্ট গত ২৯ আগস্ট প্লট বরাদ্দের যাবতীয় কার্যক্রমের ওপর তিন মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেছেন। কিন্তু আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে ক্ষমতার পালাবদলের আগেই যার যার প্লট আয়ত্তে নিতে এরইমধ্যে জমিতে বালু ভরাটসহ দখল কার্যক্রম শুরু করেছেন প্রভাবশালীরা। এ ঘটনায় কাউনিয়া এলাকায় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।
স্থানীয় ঝুমুর বেগম বলেন, আমাদের ঘরের পাশে জমি। এই জমি বরাদ্দ পেলে আগে আমরা পাবো। আমাদের না জানিয়ে মেয়র তার নিজের লোকজনকে বরাদ্দ দিয়েছেন। তারা বরাদ্দ পেয়েই বালু ভরাট করে পাকা স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেছেন। ফলে আমাদের চলাচলের রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেছে।
রাবেয়া নামে আরেক নারী বলেন, মূল ভূমিহীনদের জমি বরাদ্দ না দিয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের মাঝে এই জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা হয়েছে। আমাদের তিন হাজার টাকা দিয়ে ফরম কিনিয়ে লটারির কথা বলে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদের প্লট দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকরা পেয়েছেন এই প্লট।
বিসিসি সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে নির্বাচিত বিএন পিদলীয় মেয়র প্রয়াত আহসান হাবিব কামাল নগরীর ৩ নম্বর ওয়ার্ডে আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেও সফল হননি। ২০১৮ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আবদুল্লাহ আবাসন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছেন।
আরও পড়ুন: রেজিস্ট্রিও হচ্ছে কেডিএর ‘ভাগবাটোয়ারা’ করে নেয়া ৩২ প্লটের
এই আবাসন প্রকল্পে চার ধরনের মোট ২৪০টি প্লট করা হয়েছে। এর মধ্যে ২.৮৭ শতাংশের ১৩০টি, ২.৪৮ শতাংশের ৪৮টি, ২.৯৮ শতাংশের ৪০টি এবং ৩ শতাংশের ১২টি প্লট। প্রতি শতাংশের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৬ হাজার ৪৩১ টাকা। ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর প্লট বরাদ্দের আবেদন চেয়ে স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, স্বল্প আয়ের মানুষের বসবাস সুবিধার জন্য ১০ বছর কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য সুবিধায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে। চলতি বছরের শুরুতে লটারি প্রক্রিয়া শেষ করে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে সেসময় কারা এসব প্লট পাচ্ছেন তা সবাই জানলেও মেয়র ও প্রভাবশালীদের ভয়ে কেউ মুখ খোলেননি।
জানা গেছে, প্রকল্পে চারটি প্লট পেয়েছেন উত্তর কাউনিয়া এলাকার বাসিন্দা নাসিরউদ্দিন সাথী। তার বাড়িঘেঁষা প্লটগুলোতে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিসিসি সূত্র জানিয়েছে, অধিগ্রহণকৃত জমি নিয়ে নাসির উদ্দিনের সঙ্গে করপোরেশনের মামলা চলছিল। প্লট দেওয়ার আশ্বাসে তিনি মামলা তুলে নেন। এছাড়া প্লট বরাদ্দ পাওয়াদের তালিকায় আরও আছেন প্যানেল মেয়র গাজী নাঈমুল ইসলাম লিটু, মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক জিয়াউর রহমান, জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সুমন সেরনিয়াবাত, মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী ও তার শ্যালক মোস্তফা জামান মিলন, ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জিয়াউদ্দিন, মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী-২ শাহরিয়ার রিজন, বিসিসির প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার, চিফ অ্যাসোসর মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সানজিদ প্রমুখ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিসির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, আস্থাভাজনদের মধ্যে মোট প্লটের ১৫ শতাংশ মেয়র কোটা, কর্মচারী কোটা শতাংশ ভাগ, মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন ধরনের কোটা দেখানো হয়। এর মধ্যে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর পেয়েছেন মেয়র কোটায়। অথচ নগরীতে স্থায়ী বসতবাড়ি রয়েছে তার। তাকে প্লট পাওয়ার যোগ্য দেখাতে নীতিমালার শর্ত শিথিল করে নতুন রেজুলেশনও করা হয়েছে।
নগরীর উত্তর কাউনিয়ায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, টেক্সটাইল সড়কঘেঁষা প্লটগুলো বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। কয়েকটি প্লটে এরইমধ্যে টিনশেড স্থাপনাও তোলা হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, আদালতে রিটের খবর পেয়ে স্থাপনা নির্মাণকাজের গতি আরও বেড়েছে। তারা আদালতের স্থিতাবস্থার আদেশও মানছেন না। রিটকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির জানান, আদালত গত ৮ মার্চ মেয়রসহ চারজনের বিরুদ্ধে রুল জারি করেছিলেন। তারা এর জবাব দেননি। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত গত ২৯ আগস্ট আবাসন প্রকল্পের সব কার্যক্রমের ওপর তিন মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেছেন।
আরও পড়ুন: গণপূর্ত বিভাগের ৭ কোটি টাকার কাজে অনিয়ম
কাউনিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আদালতের স্থিতাবস্থার আদেশের কপি তারা পেয়েছেন। প্লটে বালু ভরাট বন্ধের জন্য বরাদ্দপ্রাপ্তদের মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। এরপর সাময়িকভাবে বালু ফেলা বন্ধ ছিল। কিন্তু পুলিশ চলে আসার পর আবারও বালু ফেলা হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান। এ বিষয়ে পুলিশের উচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে বিসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনা কর্মকর্তা সানজিদ হোসেন বলেন, প্লট বরাদ্দে কোনো অনিয়ম হয়নি। নিয়ম মেনেই কাজ চলছে। আর বিসিসির প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার রোহান বলেন, তারা উচ্চ আদালতের স্থিতাবস্থার কোনো আদেশ পাননি।
এ বিষয়ে বিসিসির নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, আদালতের আদেশ সবাইকে মানতে হবে। আবাসন প্রকল্পটির জমি অধিগ্রহণ এবং বণ্টনে অনিয়ম হয়েছে কি না তা দায়িত্ব গ্রহণের পর খতিয়ে দেখা হবে। নিয়ম অনুযায়ী যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্লট বরাদ্দে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
শাওন খান/এমআরআর/জেআইএম